সেবার একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যখন কোন কাগজই বের করতে পারছিলাম না। মন খুবই খারাপ। সেদিন সত্যিই খুব অসহায় অবস্থায় পড়েছিলাম। আমার সাথেই মেসে থাকতো অমল নামের এক ছেলে। পড়তো পলিটেকনিকে। গুণ গুণ গান গাওয়ার গুণ ছিলো ওর। একুশের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ও আমার মনের খবর জানতে চাওয়ায় আমি যেন আরও ক্ষেপে গেলাম। কারণ সেতো গান গেয়ে হলেও একুশে উদযাপন করবে। আমি কি করবো ? কি করবো?
ডাকে একটা কাগজ এলো। ভারতীয়। ছোট্ট কাগজটি। একটা ডিমাই সাইজের ম্যাগাজিন। এক পাতা। তিন কলামে ভাঁজ করা। আজকাল এ ধরণের অনেক কাগজ দেখি। এই যেমন কোচিং সেন্টারের প্রসপেক্টাস। আমি ওটা দেখেছিলাম সেই প্রথম। উৎসাহ পেলাম। মাত্র এপাশ ওপাশ ছাপলেই চলবে। দুই পেজ ছাপা। ভাঁজ করলে তিন কলাম, তিন কলাম ছয় কলাম হবে। ছয় কলামে অন্তত বারোটা লেখা ছাপানো যাবে।
কাগজটা হাতে নিয়ে বের হলাম। প্রেসের অবস্থা নাকে মুখে। প্রেস রাজি হতে চায় না। সময় খুব কম। কম্পোজিটরের অভাব। মনে মনে হাসি। যদি আমি করে দিই? আপনি? প্রেসের মালিক হাসে। জামায় কালি লেগে যাবে। কিছু শিখেছেন, স্বীকার করি। তাই বলে? উপায় কী !
লেখালেখি করি। পত্রিকা বের করি। অনেক বন্ধুরাও আশায় থাকবেন, লেখা ছাপা হতে পারে। নিজেরও একটা ছাপা হবে। নিজের নামটা যখন ছাপার কালিতে সামনে দেখি তখন মনের মধ্যে কেমন যেন লাগে। শিহরিত হই। প্রেসের মালিককে চাপ দিই। বলি- মান সম্মানের ব্যাপার ভাই। আপনারা যদি এতটুকু না করেন তাহলে যাই কোথায়? তিনি হাসি দিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। ছাপানোর মেশিন ম্যান বললো- সন্ধ্যায় আইস্যেন। এখন যান তো! তার মুখেও হাসি। বুঝলাম, কাজ হয়ে গেছে।
বাসায় এসে লেখা নির্বাচনে বসি। সম্পাদক আমি। কম নয় ক্ষমতা। যার ইচ্ছে তার কবিতা, ছড়া ছাপানোর ক্ষমতা তখন আমার হাতে। অনেক বেছে দুইটা কবিতা নির্বাচিত করলাম। অমল আমাকে ফলো করছে। ওবুঝতে পেরেছিলো কোন কারণে আমি আপসেট। কিছু বললো না। সন্ধ্যেবেলা গেলাম প্রেসে। মেশিন ম্যান, তার হেলপার ও একজন কম্পোজিটার আছেন। মেশিন ম্যান বললেন- দেখান কিভাবে আরম্ভ করবেন? লেখা দুটো বের করলাম। তাকে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম। হাসলো। তারপর মেটারের মাপ বলে দিলো। এবং একটা লেটার কেচ দেখিয়ে বললো- ওই চেয়ারটা নিয়ে বসুন।
রাতে খাওয়ার পর অমল ধীরে সুস্থ্যে কাছে এলো। আমি তখন আবার লেখা নিয়ে বসতে যাচ্ছি টেবিলে। ভাবলাম, রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। দেখি কি বলে? বিষয়টা জেনে খুব করে ধরে বসলো। আমার একটা লেখা ছেপে দিন। স্বভাব সুলভ ভাবে বললাম- লেখা নিয়ে আসতে। ওখুব আশ্চর্য হলো। বললো- লেখা কোথায় পাবো ?
- তাহলে ছাপবো কি ?
- আপনি লিখে দিবেন।
- আমি লিখে দেবো ? আমি লিখতে যাবো কেন ?
- আমিই লিখতাম। কিন্তু লিখতে যে পারি নে।
- তাহলে লেখা ছাপানোর এতো শখ কেন ? গান গাইছেন, গেয়ে যান। ও যেন বুঝে ফেললো এটা আমার রাগের কথা। বললো-
- আমি গান গাই, বাতাসে ভেসে যায়। ছাপানো লেখা ভেসে যায় না। দিন না একটা কবিতা ছাপিয়ে।
- এটা ছাপতে যে কাগজ লাগবে, দিতে হবে।
- দেবো, দেবো।
আমার মুখ থেকে যেন কথা কেড়ে নিয়ে বলে ফেললো। তারপর দৌড়ে গিয়ে ওর রুমে গিয়ে পঞ্চাশ টাকার দুটো নোট নিয়ে এলো। আরো আছে। কাল আপনার সাথে বাজারে গিয়ে কিনে দেবো। এটা আপাতত রাখেন। টাকাও দরকার। আবার কবিতাও লিখে দিতে হবে। কবিতা লিখে না দিলে কাগজের মান বজায় রাখা কঠিন হবে। ও জিজ্ঞেস করলো-
- পত্রিকার নাম কি ?
আমি একটা অহংকারী মানুষের মতো বললাম ‘ভাষা’।
ভাষা ?
হ্যাঁ, ভাষা।
তিন কলামের এক পাতার সেই পত্রিকা এখনো রেখেছি সযতনে। ভাষা। উচ্চারণে কেমন একটা মজা মজা লাগে। তাই না?
-
সাগর আল হেলাল
কলামিস্ট
২৪.০৩.২০২২
Post a Comment