অণুগল্পঃ বিনিয়োগ

- কবে থেকে চলছে এই ডুবে ডুবে জল খাওয়া ?
কথাটি লায়লা ভাবী অন্তত কুড়ি বার জিজ্ঞেস করেছেন শারমিনকে। শারমিন কোন উত্তর করেনি। মাথা নিচু করে বসে আছে সোফায়। কোন কথাই বলছে না। এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন সে হবে কোনদিন ভাবতেই পারে নি। পাশের ঘরে রিটায়ার্ড সাবেক সিএসপি অফিসার আনসার বিন কাশিম মুখ ভার করে বসে আছেন। সকালের দিকে কিছু চেচামেচি করেছিলেন। এখন শান্ত হয়ে এসেছেন। মানুষের জীবনে বয়সও একটা বিরাট ফ্যাক্টর। বাবার আগের দিন থাকলে- যে পরিমাণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন, তাকে এতোক্ষণ হাসপাতালে থাকতে হতো- সে কথা জানে শারমিন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে মাস্টার্স করেছে শারমিন। রেজাল্ট বেরনোর পর বেশ উঁচু উঁচু ফেমিলি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। শারমিন সম্মত হয়নি। বাবা তার সাথে এ নিয়ে কথা বলেন নি। খালা, চাচী, মামী সকলেই চেষ্টা করেছেন, নিষ্ফল। বন্ধু-বান্ধবরাও ফেল মেরেছে। শারমিনের এক কথা- বাবার মতো সৎ আদর্শ অফিসার হবেন। এই দেশ তাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সম্মান দিয়েছে। ভাষার গৌরব দিয়েছে। দেশের জন্য অনেক কিছু করার আছে তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে সে হিসেব করে দেখেছে, সীট ভারা হিসাবে শিক্ষার্থীরা যে টাকা হল কর্তৃপক্ষকে দিয়ে থাকে তা দিয়ে হলের পানির বিলও হয় না। দেশের গরীব-দরিদ্র-অসহায় মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে। সেই গরীব অসহায় মানুষের কাছে সে ঋণী। সেই ঋণ তাকে শোধ করতেই হবে। সুতরাং ভালো একটা চাকরী না পেয়ে সে বিয়ের আসনে বসতে পারে না।

- আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম ! বাবার মান-সম্মানের কথাতো একবার ভাবতে পারতে!

লায়লা ভাবী অন্য কৌশলের আশ্রয় নেন। শারমিনকে তিনি ভাঙতে চান। জানতে চান মনের সেই সকল অজানা কথা যা সে মনের গহীনেই বাক্সবন্দী করে রেখেছে। তাছাড়া শারমিন এখনতো আর ছোট নেই। তার কিসে ভালো আর কিসে মন্দ, তা সে ভালো করেই জানে। কিন্তু ভাবীদেরওতো অধিকার আছে ননদিনীর মনের কথা জানবার ! আর সে কারণেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ ঘরে আসছেন এবং শারমিনকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করছেন। বিষয়টি যতক্ষণ তার অজানা থাকবে, মনে শান্তি নেই যেনো তার।

- তোমার ব্যাচমেট সেই ছেলেটা নয় তো?

শারমিন হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ে। লায়লা ভাবী নড়ে চড়ে বসেন। শারমিনের মন নড়েছে। এবার সে বিষদ জানতে পারবে।

- মন্দ না, আমরা কি তাকে অপছন্দ করতাম ? সে তো দেখতে অনেক সুন্দর ! ক্যাডার সার্ভিসের চাকরী। এনবিআর-এ পোস্টিং। বাবাও নিশ্চয়ই অপছন্দ করতেন না ?

- আচ্ছা, তুমি জানো- কি হয়েছে ? উল্টো প্রশ্ন করে শারমিন।

- জানবো কি করে ? সকালে পেপার খুলেই বাবা তোমার আর ঐ ছেলেটার নাম নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করলেন। তারপর পেপারটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে সামনে করে চুপচাপ বসে আছেন। তুমিতো জানো, বাবা রেগে গেলে আমরা কেউ-ই ওনার ধারে-কাছে যাই না।

শারমিন অফিসে যাওয়ার জন্য গেটের সামনে যেতেই পেপার ওয়ালা আসে। কি মনে করে যেন সে পেপারটা নেয়। প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম দেখেই হকারকে সে পেপারটা ফেরত দেয় বাসায় দেওয়ার জন্য। নিজে অতিরিক্ত আরেক কপি কিনে নিয়ে সেও বাসায় ফেরে। আজ আর তার অফিসে যাওয়া হয় নি। এসে সেই যে এই সোফায় বসেছে, আর ওঠেনি। পেপারটা লুকিয়ে রেখেছিলো এতোক্ষণ। এবার সে লায়লা ভাবীর হাতে পেপারটা তুলে দেয়।

লয়লা ভাবী পেপারটা হাতে নিয়ে স্পীড মানি সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম শেষে পুরো খবর পড়তেই যাবে। কিন্তু হঠাৎ বাবার কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাবা শারমিনের মাথায় হাত রেখে বলছেন- লড়ে যা, আজ আমি আমার বিনিয়োগ সুদ সমেত ফিরে পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। শারমিন তার কান্না সংবরণ করতে পারে না। সেই দেখাদেখি লায়লা ভাবীও।
-

সাগর আল হেলাল
৩১.০৩.২০২২

Post a Comment

Previous Post Next Post