মহান ঈশ্বরের মনোনীতরাই আসে পৃথিবীতে। ফিরে যায় তাঁর কাছে, তাঁরই ইচ্ছায়। মানুষ ঈশ্বরের প্রতিনিধি। প্রথম মানুষ মাটির, তারপর তার নির্যাসে। মাটির মানুষকে আগুনের আযাযীল সেজদা না করলে, ঈশ্বর বললেন- “তোমার জ্ঞানের চেয়ে আদমের জ্ঞান বেশি। সুতরাং মানুষে নিহিত সকল জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধিমত্তা সবকিছু ঈশ্বর প্রদত্ত। ঈশ্বরের প্রতিনিধি করে যায় সকল কাজ ঈশ্বরেরই ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। না একটু কম, না সামান্য বেশি। সকল কিছুই পূর্ব নির্ধারিত। ঈশ্বরের হাতের পুতুল তাঁর সৃষ্টিকুল। কাজী নজরুল ইসলাম তাই-কি গেয়েছেন- “খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে, খেলিছো----”।
মির্জা তাহের জামিল ও ঈশ্বরের মহা-পরিকল্পনা
পাবনা সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের পয়দা গ্রামের মুসলিম সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান ক্ষণজন্মা প্রতিভাবান গল্পকার এই মির্জা তাহের জামিল। পিতার নাম মির্জা আমজাদ হোসেন। পাবনা শহরের কেন্দ্রস্থলে শালগাড়ীয়ায় ওদের শহরের বাড়ি। আমি যখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ি, সে-ও তখন এডওয়ার্ডেরই ছাত্র। গ্রাম থেকে কলেজে যাই, শহুরে বন্ধু নেই। যেহেতু লেখালেখির ঝোঁক। সে থেকেই লেখক বন্ধুর খোঁজ এবং মির্জার সাথে আমার পরিচয়। মির্জা তাহের জামিলকে আমি মির্জা বলে ডাকতাম। আমি বয়সে একটু বড়ো থাকায় ও আমাকে সাগর ভাই বলে ডাকতো।নব্বই এর দশক। আন্দোলনকাল। কবি-সাহিত্যিকের লেখার উপকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। কতো রকম ছড়া কবিতা-ই না লেখা হয়েছে সে সময়। দৃষ্টান্ত না দিয়ে, বিষয়ে থাকি। মির্জা তাহের জামিলের বাসা শালগাড়ীয়ায়। বাসার পূর্ব পার্শ্বে একটা বিরাট পুকুর। মনে হতো, বাড়িটা কী পুকুরে গড়িয়েই পড়ে। যদিও সেই পুকুরটি এখন আর নেই। সে এখন নগর সভ্যতার অংশ। ছাত্র জীবনের লেখালেখিটা সকলেরই আরম্ভ হয় বুঝি গোপনে। বিশেষ করে বাড়ির অভিভাবক থেকে। আমি যতবার ওর সাথে শালগাড়ীয়ায় গিয়েছি, আমাকে চুপিচুপি বলতো- “এখানে একটু দাঁড়ান। আমি, এক্ষুণি আসছি।” আমি দেখতাম, বাড়ির গেটের কাঠের দরজাটা ওকে খুব ধীরে ধীরে খুলতে। তারপর কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে, একটু হাসি দিয়ে বলতো- “চলেন”। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তার উল্টো দিকে ছিলো ইসলামী ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরি। সাহিত্য পত্রিকা দেখতে যেতাম। তার আগে সারতাম সরকারি পাবলিক লাইব্রেরির কাজ। কলেজ থেকে ফেরার পথেই ছিলো সেটা আব্দুল হামিদ রোডে। সবার শেষে যেতাম- অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে। এটা প্রায় রুটিন কাজ ছিলো। কোনোদিন পেটে দানা-পানি পড়তো, কোনোদিন পড়তো না। কোনো কোনোদিন টাউন হল মাঠে আড্ডা হতো। মাঝে মাঝে আরও একজন সাথে থাকতো, তার নাম ইসলাম আল ফেরদৌস। খনার বচনের বাস্তবায়ন হতো তিনজন হলে। একে গুনগুন দুইয়ে পাঠ, তিনে গোলমাল চারে হাট। মির্জা বলতো বেশি। সবশেষে, আমি ফিরে যেতাম গ্রামে। ইসলামের বাড়ি পৈলানপুরে আর মির্জা যেতো শালগাড়ীয়ায়।
সে সময় লেখা প্রকাশের সুযোগ ছিলো খুব কম। পাবনাতে মাত্র দুইটি সাপ্তাহিক ‘সাপ্তাহিক পাবনা বার্তা’ ও ‘সাপ্তাহিক বিবৃতি’। আরও একটি অনিয়মিত সাপ্তাহিক ছিলো- ‘সাপ্তাহিক দূরদৃষ্টি’। এসব পত্রিকায় সিনিয়রদের দাপটে আমরা নবীনেরা খুব কমই সুযোগ পেতাম। ও শহরের ছেলে বলে ওর পরিচয়টা বেশি ছিলো। পরিচয় বাড়ানো ও একসাথে আড্ডা দেয়ার লোভেই গ্রাম থেকে শহরে মেসে আসি আমি। ওরও যেনো সুবিধে হলো। আমার কাছে আসতো খুব। গল্প আড্ডার শেষ ছিলো না। দেশের বিভিন্ন এলাকার সাহিত্য ম্যাগাজিনে লেখা পাঠানো, নিজেরা বিশেষ দিবসে সাহিত্য ম্যাগাজিন বের করা ইত্যাদি কাজ রুটিন মতোই করতাম। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিলো না।
ঢাকাতে চাকরী করছি। হঠাৎ একদিন মির্জা হাজির। অন্যরকম চেহারা। ভালো থাকার অভিনয় প্রচ-। বাসায় নিয়ে গেলাম। অনেক কথা। অনেক, অ-নে-ক। আমার মতো সে-ও বেতারের গীতিকার হয়েছে জানতে পারলাম। আমার কাছে রাতে থাকতে বললাম। থাকলো। রাতে বললো-
- বাংলা একাডেমি লেখক সৃষ্টির জন্য প্রকল্প নিয়েছে। চলেন ভর্তি হই।
- চাকরী করে আমার সময় কোথায়?
- আমি ভর্তি হতে চাই।
- অবশ্যই। সুযোগ পেলে ছাড়বেন কেন?
- তাহলে, আমি একটা থাকার জায়গা ঠিক না করা পর্যন্ত আপনার কাছে থাকবো।
ওকে না বলার মতো ভালোবাসা ছিলো না। আমার বাসা আগারগাঁ-শ্যামলী। ঢাকায় এটাই আমার প্রথম বাসা। বেকার সময় থেকেই। গান লিখতাম। সদ্য বেতারে তালিকাভূক্ত হয়েছি। উদ্যোমটা বেশি ছিলো। বেতারের পাশে বাসা নেয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ। সকালে টিউশনি আর সারাদিন বেতারে সময় দেয়া। সুরকার মিউজিশিয়ানদের চা আপ্যায়ন। কতো কাপ চায়ের বিল দিয়েছি তা মনে নেই, তবে চা গুলো একত্র করলে হয়তো কয়েক ড্রাম হয়ে যেতো। কষ্টের টিউশনির টাকা এভাবেই খরচ হয়ে যেতো। চাকরী পাওয়ার আগ পর্যন্ত আরও অনেক কিছু করেছি সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। অবশেষে চাকরী সরকারি অফিসে। এ্যাকাউন্টস অফিসার। দ্বিতীয় শ্রেণির পদ এটি। বেতন ৩৪০০ টাকার স্কেলে। এই সামান্য বেতনের চাকরী নিয়ে বেশ খানিকটা ঠাট্টা-মশকরা করলো মির্জা। বললো-
- এ দিয়ে চলেন কিভাবে!
- চলতে হয়। আবার জমাতেও হয়। বাড়িতে ঘর-দোর নেই। ঘর তুলছি। সেখানে অনেক টাকার প্রয়োজন।
- কিসের জন্য এতো কষ্ট করছেন?
- কষ্ট কি, ব্যাচেলর হয়ে সেপারেট রুম নিয়ে থাকি। এর চেয়ে ঢাকায় আর কি সুবিধে চান। এ কি পাবনা নিজের বাড়ি পেয়েছেন ? বিরাট উঠোন, বারান্দায় চৌকি ফেলানো যায়। ঢাকাতে এসেছেন- কিছুদিন থাকেন, তারপর বুঝবেন।
ও হেসে গড়িয়ে পড়ে। সামান্য রাগ হলেও চেপে যাই। ও আবার যেই রকম মানুষ যদি ভেবে বসে যে, ও থাকতে চেয়েছে বলে রাগ দেখাচ্ছি। তাহলেই সেরেছে। বহুদিন পর এসেছে। আমি আমার কথা রেখে ওর সম্পর্কে বলতে বলি। নতুন লেখক সৃষ্টি প্রকল্প নিয়ে ও বেশ এক্সাইটেড। লেখালেখি এখন আর শুধু ভাবনার জগত নেই। লেখার কৌশল, ক্লাইমেক্স তৈরীর টেকনিক এগুলো এখন প্রশিক্ষণের বিষয়। বাংলা একাডেমি এতোদিনে একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। সুযোগ পেলে আমি খুব খুশি হবো। তাছাড়া, শাহাবাগ, আজিজ মার্কেট, পাবলিক লাইব্রেরি এদিকেও সময় দিতে পারবো। লেখালেখি করতে হলে ঢাকায় থাকাটাই একটা বিরাট ব্যাপার। এছাড়া, বই পড়ারও সুযোগ পাবো। আমি ওর সাথে সহমত প্রকাশ করে ঘাড় নাড়ি। এলাকার কিছু কথাও বললো। গ্রাজুয়েশন শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আমার বাসার লোকেশন এমন জায়গায় হওয়ায় ওর সুবিধেই হলো বলে মনে হলো। যাহোক, পরে আমার বাসা থেকেই ওর বাংলা একাডেমির যাত্রা শুরু। ভর্তি, ক্লাস চলতে থাকলো। সকালে দুজন একসাথে বের হয়ে আমি অফিস আর মির্জা বাংলা একাডেমিতে। ও ফিরতো অনেক দেরি করে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে কেন্টিনের কথা বলে। সমস্যা হচ্ছে না এমন কথাও বলে। আমি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে, অট্টহাসি দিয়ে বলে- আপনার কাছে লুকানোর কি কিছু আছে? বাংলা একাডেমিতে আরও কি কি সুবিধা আছে তার ফিরিস্তি দিতে থাকে। যেহেতু দুপুরের বিষয়ে আমি কিছু করতে পারবো না, তাই চেপে যাই। এভাবে মাস খানেক চললো ভালো মতোই। তারপর একদিন গেলো, আর ফিরলো না। খারাপ লেগেছিলো খুব। এভাবে কেউ চলে হয়? কিন্তু কি করার আছে। রাগ করে আমি আর বাংলা একাডেমিতে ওর খোঁজে যাই নি। এক সময় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পরে লোকমুখে শুনতে পারি কোর্সটা সুন্দর মতো শেষ করেছে এবং একাডেমির প্রকল্পের আওতায় গল্পের বইও বের হয়েছে। গল্পগুলো নাকি খুব সুন্দর। মনে মনে খুশি হই। ওর সাথে সাক্ষাতের আকাক্সক্ষা বাড়ে। ফোন নম্বরও নেই যে, যোগাযোগ করবো। কোথায় আছে তা-ও জানি না। একবার শুনলাম- চাকরী পেয়েছে ভালো একটা। এমন খবর শুনে কে না খুশি হবে! আমি দূর থেকে খুশিই হয়েছি। এ ছাড়া আর কি-ই করার ছিলো আমার!
ঢাকা থেকে নিজ জেলা পাবনা এলে ওর কথা মনে পড়েই। কিন্তু দেখা হয় না। ওদের শালগাড়ীয়ার দালানের পাশের পুকুরে এখন বিরাট এক মহল্লা। দেশের মানুষ বেড়েছে? মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে। একটু বুঝ-সুজ আছে এমন মানুষ আর গ্রামে থাকতে চায় না। সন্তানের লেখাপড়া ও একটু ভালো থাকার আশায় শহরে পাড়ি জমায় মানুষ। আমার কিন্তু গ্রামই ভালো লাগে। আজ অব্দি শহরে বাড়ি করার খেয়াল আমার মাথায় আসে নি। এলে কী ভালো হতো? ঢাকা থেকে গ্রামে আসি। প্রতিবারই ভেবে আসি, এবার মির্জার গ্রামের বাড়ি গিয়ে হলেও দেখা করবো। কিন্তু বাড়ি আসি। সংসারের এ কাজ সে কাজ, আত্মীয়তা ইত্যাদি সারতে সারতে সময় চলে যায়। সাক্ষাৎ হয় না। আমি ঢাকা ফিরে যাই। সর্বশেষ ২০১৪ তে মরিয়া হয়ে নানা জনের কাছে খোঁজ করতে থাকি। আমার যারা বন্ধু-বান্ধব তারা কে কোথায় গেছে জানি না। পরিচিত যাকে পাই তার কাছেই জিজ্ঞেস করি মির্জার কথা। অবশেষে জানতে পারি ও এখন গ্রামেই আছে। তবে কেউ বাড়ির লোকেশন দিতে পারে না। মির্জার ফোন নম্বরও নেই কারো কাছে। একদিন শালগাড়ীয়ায় ওদের বাসাটা যেখানে ছিলো সেখানে যাই। আশ-পাশের লোকের কাছে ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায় যদি, এটাই আশা। ওদের বাড়ির প্লটের তার একদম পেছনে একটা ছোটো বাসা দেখা যায়। যা হয় হবে ভেবে বাসায় নক করি। একজন বয়স্ক মানুষ আসেন, তার কাছে বিষয়টা বলায় তিনি বলেন- আমি তার ভাই, ও গ্রামেই আছে। ওনার কাছ থেকে মির্জার ফোন নম্বরটা পেয়ে যাই। ফোন করলাম। রিং বাজে, ধরে না। আবার। এবার ধরলো। ওপাশ থেকে পরিচয় জানতে চাইলো। কণ্ঠ শুনে বুঝলাম মির্জা। আমি ফোন করায় ও বেশ খুশি হয়েছে বুঝা গেলো। বললো- ‘২০মিনিট সময় দেন, এক্ষুণি আসছি’। যদিও সময়টা ২০মিনিটের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি লাগলো। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মির্জা হাজির হলো তাঁতী মার্কেটের গেটে। কমপক্ষে ১৫/১৬ বৎসর পর দেখা। আমাকে এআর কর্ণারের পেছনের দিকে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে বসালো। বললো-
- শহরে এলে আমি এখানেই চা খাই। দুজনে একসাথে চা খেলাম।
- গ্রামে কী করছেন? হাসতে হাসতে বললো-
- জমি চাষের কাজ করছি।
গ্রামে ভালোই আছে, এমনটা বুঝানোর চেষ্টা করলো। একজন লিখিয়ে গ্রাম ভালোবাসে, পছন্দ করে এ কথা সত্যি। কিন্তু লেখকের বিকাশ হয় শহরে। মির্জা স্থায়ীভাবে গ্রামে থাকছে জেনে খারাপ লাগলো। পরের দিন আবার এলো, কথা হলো। একসাথে ছবি উঠলাম। আমার বাসার ঠিকানা-লোকেশন, মোবাইল নম্বর দিলাম। ও আমাকে বিদায় দিলো টাউন হলের পাশে। মনে কিছুটা স্বস্তি এবং দীর্ঘদিন দেখা না হওয়ায় বুকের ভেতরে যেই অস্থিরতা ছিলো তার অবসান ঘটিয়ে আমি আমার নিজের গ্রামে ফিরে যাই।
পরের বছরের একুশে বই মেলা উপলক্ষে মির্জা তাহের জামিল আমার বাসায় আসে। আমার বাসা তখন মধুবাগ, মগবাজারে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নতুন অভিধান ১ম খণ্ড কিনেছে ও। বেশ ছটফট করছিলো। থাকতে পারবে না। এমন একটা ভাব যেনো ওর খুব তাড়া আছে। তবুও একদিন আটকে রাখলাম। বললাম-
- অন্তত ভ্রমনসূচিটা শেয়ার করেন!
- সব জায়গাতেই গিয়েছি।
আমি একটু আশ্চর্যই হলাম। যে মানুষটা ঢাকায় থাকার জন্য পাগল ছিলো। সে আজ একদিন ঢাকাতে থাকতে চাইছে না! বিষয়টা আজও আমার কাছে রহস্য। কোনো একটা বিষয়ে মোহাবিষ্ট হয়ে গেলে যেমন হয়, তেমন আর কি। এখন গ্রামেই একটা কিছু করতে চায় ও। ঢাকার প্রতি ঘৃণা। আরও একান্ত কিছু কথা জানতে পারি। সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছে রইলো। গ্রামে একটা উন্নয়ন সমিতি করেছে। সেটা নিয়ে ব্যস্ত এখন। বেশ কিছু সদস্য হয়েছে। সমিতিকে এনজিও-তে উন্নীত করার প্রয়াশে ওসাকায় সহযোগিতার জন্য গিয়ে ব্যর্থ হয় সে। কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগলো। মির্জার সাথে যখন পরিচয়, ঐ একই সময় মজিদ মেহমুদ (বর্তমানে মজিদ মাহমুদ)-এর সাথেও পরিচয়। তিনিই ওসাকা এনজিও’র মালিক। মির্জা সমিতি পরিচালনার জন্য আমার কাছে কিছু সাপোর্ট চায়। ও যতটুকু সাপোর্ট চেয়েছিলো, দিতে পেরেছিলাম ভেবে আজকের দিনে খুব ভালো লাগছে। যাই হোক, সমিতি আরম্ভ করে ভালোই আছে ফোনের মাধ্যমে জানতে পারি। কিছুটা নিশ্চিন্তবোধ করি।
কতোদিন গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ মোবাইল বন্ধ। বন্ধ তো বন্ধই। একদিন, এক সপ্তাহ, একমাস, বেশ কয়েক মাস। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পাবনা এলাম। দৈনিক পাবনা বার্তা অফিসে মোসতাফা সতেজ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। জানতে পারলাম তার আহত হওয়ার বিস্তারিত বিবরণ। বুকের মধ্যে কেমন লেগেছিলো বলতে চাই না। সতেজ ভাই বললো- মির্জার ছোটো ভাই রানা বিস্তারিত বলতে পারবে। যে ধরণের দুর্ঘটনা, ও বেঁচে আছে এটা জেনেই ভেতরে ভেতরে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। সন্ধ্যার পর। মোবাইল ফোনে যোগাযোগের পর রানা এলেন। ওই দিন থেকে মির্জা রানার সাথে পরিচয় হলো। রানা একটু কথা কম বলে এমনই আমার মনে হলো। বেশি ভিঁড়লাম না। কিভাবে যেতে হবে বিস্তারিত জানলাম। রাতে গ্রামে ফিরে আসি।
রাত পোহালে পয়দা গ্রামে যাবো। ওখানে গেলে মির্জার দেখা পাবো। এতো বড়ো বিপদেও ও আমাকে সংবাদ দেয় নি। সারারাত ঠিক মতো ঘুম হলো না। সূর্য্য ওঠার আগেই আমার গ্রাম থেকে বের হলাম। পাবনা শহরের চাঁপা মসজিদের ওখানে তখন সবে সিএনজি আসতে আরম্ভ করেছে। প্যাসেঞ্জার নাই। সিএনজি চালকরা বললো- টার্মিনালে গেলে সুবিধা হবে। এখান থেকে যেতে দেরী হবে। মনে মনে ক্ষেদোক্তি করলাম। এইমাত্র টার্মিনাল এর উপর দিয়েই গিয়েছি। আবার রিটার্ণ এলাম টার্মিনালে। সকালের রোদ কেবল হাসতে শুরু করেছে। শীতের সকাল। রোদ বড়ো মিষ্টি লাগে। সিএনজির ড্রাইভারেরা বগলে হাত দিয়ে জড়ো হয়ে গল্পে মগ্ন। আমি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। আমাকে তারা কোনো পাত্তা দিলো না। বোধগম্য হলো না। শেষে আবার বললাম, সমস্যা কি ?
- কেবল রাত পোহালো- প্যাসেঞ্জার আসতে দিন।
- একাই যাবো। এবার ওদের আগ্রহে পানি এলো।
- তাহলে রিজার্ভ নিতে হবে।
- হ্যাঁ, তাই নেবো। বলেন কতো চান? ওরাও কম যায় না।
- ২০০ টাকা দিবেন। আমিও দাঁও কষলাম।
- তোমার সিএনজিতে যে কয়জন প্যাসেঞ্জার ধরে, সেই কয়জনের ভাড়া দেবো- বেশি দেবো কেন?
১৫০ টাকায় ভাড়া মিটিয়ে চললাম পয়দা গ্রামের উদ্দেশে। একা। শীতের সকাল। ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে চোখে মুখে। বাতাসে ঠাণ্ডার দাপট থাকলেও শীতের সকালের বাতাস অন্যরকম ভালো লাগায়। ডানে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পরে বামে পাবনা ক্যাডেট কলেজ পেছনে ফেলে এগিয়ে যাই। সিএনজি বামে ঘাড় ফেরায়। এরপর কোথাও বাড়িঘর, কোথাও ফাঁকা। গোঁ গোঁ শব্দে এগিয়ে যায় সিএনজি। মনে নানান প্রশ্ন ভীঁড় করে। কী দেখতে পাবো পয়দা গিয়ে? একটা প্রশ্নের উত্তর মনের মধ্যে দাঁড় করাতে করাতে, আরেকটা প্রশ্ন এসে যায়। এভাবে মস্তিষ্কে সময় কাটাতে কাটাতে পৌঁছে যাই গয়েশপুর। সিএনজি’র এটা শেষ গন্তব্যস্থল। এবার যেতে হবে নতুন পথে। ভদ্রলোক বামের রাস্তা দেখিয়ে সিএনজি ঘুরায়। শহরে ফিরবে। বামের রাস্তাটা একটু নিচু হয়ে ছোট্ট একটা ব্রীজ। একটা ভ্যান ঠিক করে উঠে বসি তাতে। ভ্যান নিচু রাস্তা থেকে উঁচু রাস্তায় ওঠে। বেশ উঁচু। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ অসংখ্য গাছ। কোথাও মেহগনি, কোথাও লাজুক ইউক্যালিপটাস। রাস্তার পাশ ঘেঁসে খাল। রাস্তা থেকে খালের জল অনেক নিচু মনে হয়। সেই জলে প্রচুর হাঁস। ইউটিউবের ভিডিও ছাড়া সরাসরি এতো হাঁস আগে আমি দেখি নি। একটা পঙ্খী অনেক দূর থেকে উড়ে এসে ঝুপ করে জলে পড়লো। পঙ্খী ওড়ার দৃশ্যটাও আজই প্রথম দেখলাম। আমাদের এলাকাতেও কেউ কেউ পঙ্খী পোষে, কিন্তু এমন জলের ব্যবস্থা না থাকায়, তারা যে উড়তে পারে তার প্রদর্শনী করতে পারে না। যেতে যেতে একটা প্রাথমিক স্কুল পড়লো। তিন রাস্তার মোড়ে, হাতের ডানে। সামান্য পরেই একটি কবরস্থান। এটা প্রতিষ্ঠা করেছে মির্জা তাহের জামিলের বাবা মির্জা আমজাদ হোসেন এমনই লেখা আছে সাইনবোর্ডে। এরপর আরেকটি মোড় বামে গেছে কাঁচা রাস্তা আর সোজা গিয়েছে পাকা। চায়ের দোকান। কিছুক্ষণ আগেই খুলেছে। সকালে যারা চা খায়, তারা অপেক্ষমান। চাওয়ালা চুলা ধরাতে ব্যস্ত। ভ্যান অলা বললো- এইটা পয়দা গ্রাম। ভ্যান থেকে নেমে দোকানের দিকে এগিয়ে যাই। উপস্থিত লোকেরা ঔৎসুক্য হয়ে ওঠে। হাতে ক্যামেরা এতো সকালে পয়দায় কি ঝামেলা পয়দা এসেছি এমনই যেনো ভাব। বললাম-
- চা হবে?
- বসেন। কোথায় যাবেন?
- মির্জা তাহের জামিলের বাসায়।
আমার বাড়ি কোথায়, মির্জা আমার কে হয় ইত্যাদি প্রশ্ন এলো। আমি সংক্ষিপ্ত জবাব দিতে দিতে চা এলো। চায়ে মন দিই। একজন বললো-
- মুন্নুদের বাড়ি তো এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। কাঁচা পথে। মির্জাকে গ্রামের ও পরিবারের লোকেরা মুন্নু বলে ডাকে।
তারাই নিজ উদ্যোগে ভ্যান অ’লাকে মির্জাদের বাড়িতে আমাকে দিয়ে আসার কথা বললো। সে অতিরিক্ত আরও দশটাকা নিলো। আমি যখন মির্জাদের বাড়িতে পৌছলাম, ওদের বাড়ির কেউ কেউ তখনো ঘুমে ছিলো। ওদের বাড়িটা রাস্তার পাশে নয়। রাস্তার পাশে ওর ভাইয়ের বাড়ি, তার পেছনেরটাই ওদের। বাড়ির সামনে বাহির বাড়ির ঘাসে শিশির। জুতা ভিজে যাচ্ছিলো। ডেকে বসলাম। মির্জা জেগে উঠেছিলো। সকাল আটটায় নাস্তা করে ওষুধ খায় ও। তখনো নাস্তা খায় নি ও। দক্ষিণ দূয়ারি ঘরের ছোট্ট একটি খোলা জানালার পাশে বসা। জানালা দিয়ে মুখ দেখা যাচ্ছে। ঐ মুখ যে কারো পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন। একটা বাচ্চাকে আমার বসার জন্য উঠোনে একটা চেয়ার দিতে বললো। আমাকে বললো- আপনি বসেন, আমি বাথরুমটা সেরে নিই। ঘরের ভেতরেই চেয়ারে বসে বাথরুম করলো মির্জা। ল্যাট্রিনে বসতে পারে না। বাথরুম শেষে বের হয়ে এলো মির্জা তাহের জামিল। ক্র্যাচে ভর দিয়ে। চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল মির্জা- আজ বিমর্ষ। আমাকে দেখে জোর করে হাসলো। আমাকে আপ্যায়ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি বললাম- এসেছি যখন, তখন খেয়েই যাবো। আপনি শান্ত হয়ে বসুন।
সারাদিন ছিলাম সেদিন আমি পয়দা গ্রামে। খালাম্মার রান্না চলাকালীন সময়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখালেন। ওদের বাড়ির পশ্চিমে বিরাট একটি পুকুর। পুরনো একটি ঘাটও রয়েছে। শীতের দিন হওয়াতে ছায়ার চাদরে ঢাকা পুকুরের জল যে বেশ শীতল, বুঝাই যাচ্ছিল। মির্জা বললো- এই পুকুরেই আমরা গোসল করি। বাড়ির দক্ষিণেও একটি ছোটো আকারের পুকুর আছে। কোন পুকুরে কোন মাছ আছে, কোন কোন দিন মাছ মেরে থাকে সব গল্প করে গেলো। বুঝা গেলো মাছ ওর খুব প্রিয়। বাড়িতে ফ্রিজ আছে। সেখানে কি কি মাছ সংরক্ষিত আছে তা-ও বললো। খালাম্মাকে সেখান থেকে বড়ো মাছ নিয়ে রান্না করতে বললো। ওর কথা অনুসারেই রান্না হলো। খালাম্মার হাতের রান্না খেয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আমার মা ২০১১ সালে ওফাত পেয়েছে। মনে হলো, সেই মায়ের হাতের রান্না খেলাম। লোকে বলে- যার যার মায়ের হাতের রান্না তার তার কাছে প্রিয়। আমার কিন্তু তা মনে হলো না। মির্জা খাওয়ার সময় আরও এক টুকরা বড়ো মাছ পাতে তুলে দিলো। সেটা শেষ করতে বুঝে গেলাম, খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। কথা না বলে রানার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাতঘুম বিকেল এনে দিলো।
ঘুম থেকে উঠে একটু কৃত্রিম রাগ দেখাই। বাড়ি ফিরতে হবে। মির্জা ওর প্রকাশিত বই দেখালো। লেখা-লেখি নিয়েও বেশ কিছু কথা হলো। ওর কথা-বার্তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ওর মনে একটা সন্দেহের বীজ কেউ বুনে দিয়েছে। শুনেছি, একাকীত্ব মানুষকে এমন বার্তা দেয়- যার কোনো অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে। ও বললো- কেউ অনুসরণ করছে। এ জন্যই বই মেলায় গিয়ে বেশি দেরি করে নি। আর ঢাকাতেও থাকেনি। অনুসরণকারীরা নাকি ওর গ্রামেও এসেছিলো। আরও অতি কাল্পনিক কথাবার্তা হলো। আমি ধরে নিলাম হয়তো নতুন কিছু লেখার জন্য নিজের জীবনের ঘটনাবলীর সাথে কল্পনার সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। মনোযোগ সহকারে শুনলাম। শেষে বললাম, গল্পের প্লটটা খুব ভালো। এ কথায় মনে হলো বেজার হলো। বললো- সময় এলে দেখতে পারবেন। বাংলা একাডেমিতে থাকা অবস্থায় করা কিছু কাজের কথা বললো ও। সেখানে ওর অনেক টাকা পাওনা আছে, এমন ঈঙ্গিতও দিলো। নাট্যকার সুলতান মুহাম্মদ রাজ্জাক ভাইয়ের কথাও এলো প্রসঙ্গক্রমে। ওর কথায় বুঝলাম ঐ সময়ের কিছু বিষয় হয়তো তিনিও জানেন। আমি এ বিষয়গুলো নিয়ে আর বিশেষ ঘাটাই না। খালাম্মা ফিরনি পাক করেছেন। সেটা এলো। খেয়ে দেয়ে বললাম- এবার যেতে হবে। বেলা একদম পড়ে এলো। খালাম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মির্জার বাড়ি থেকে বের হলাম। আমাকে আমার বাড়ির পথে এগিয়ে দিতে দিতে পথিমধ্যে এসে বললো- সময় একদমই কাটতে চায় না।
মির্জার ছোটো ভাই মির্জা রানা। পত্রিকা সম্পাদনা ও মুদ্রণের কাজ করে। বাসায় কম্পিউটারও দেখলাম। ভাবলাম, ইন্টারনেট চালালে একাকীত্ব যাবে। পরে গ্রামীণ ফোনের সীমকার্ডসহ একটি মডেম উপহার পাঠিয়ে দিলাম। মোবাইলে বললাম- সীমকার্ডটা কিন্তু ফেরত দিতে হবে। ও রাজী হলো। ফেসবুকে আইডি খুলে আমাকে যুক্ত করলো। মাঝে মাঝে টেলিফোনেও কথা হতো। আমি ঢাকা আর ও পাবনা মনেই হতো না। কম্পিউটার অন করলেই সামনে। তবে নেট চালু হওয়ায় ফোনকল কমে গেলো। নিজেতো ফোন করতোই না, আমি ফোন করলে কখনো ধরতো আবার কখনো ধরতো না। তারপরও আমি ফোন করতাম। মাঝে মাঝে কথাও হতো। মির্জা ফোন না ধরলে রানার নম্বরে ফোন করতাম। এভাবে মির্জাকে কেন্দ্র করে রানার সাথেও ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। রানা গান করে। আমি লেখার চেষ্টা করি। সম্পর্কটা গাঢ় হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে।
মির্জা ঢাকায় এলো ক্ষাণিকটা সুস্থ্য হয়ে। তবে নিওরো প্রব্লেম ছিলোই। দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে থাকার ফল। হাতির ঝিলে হাটতে নিয়ে যাই। কোনো কোনোদিন হাতিরঝিলে রাত অব্দি গল্প করে কাটে। আমার বাসায় ও এক মাসের বেশি সময় ছিলো। একটা রুম ওকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওর ডায়াবেটিস ছিলো। ডায়াবেটিকের মানুষ বাথরুম ব্যবহার করলে যা হয়। কাজের বুয়া খুব বেজার। মুখে কিছু না বললেও গজগজ করতো। মির্জা যাতে বুঝতে না পারে, সেজন্য ওকে ঘুমে রেখে রাতে গোপনে কেনা ফিনাইল দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করি আমি নিজে। ঐ একমাস খুব মজা হয়। অফিসের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় দুজন একই সাথে কাটিয়েছি। আমি অফিসে যাওয়ার পর ও বাসায়ই থাকতো। একদিন এসে দেখি বাসায় নেই। চিন্তায় পড়লাম। রাতে ফিরলো। বললো- ‘এতো চিন্তা করেন কেন? শাহাবাগে গিয়েছিলাম। এর পর মাঝে মাঝেই শাহাবাগে যেতো। ভাবলাম, যদি ঢাকায় মনটা বসে! কিন্তু আমার ভাবনায় ইতি ঘটিয়ে ও আবার পাবনায় ফিরে এলো।
ঢাকা থেকে পাবনায় আসবো। মির্জাকে ফোন করলাম। ও বললো- গাড়ি থেকে নেমে সোজা শাপলা হোটেলে আসেন। আমি অবাক। কিন্তু কথা বাড়ালাম না। রাতে নাইটকোচে এসে ভোর বেলা ওর খোঁজ করতেই পেয়ে যাই। চিকন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে করিডোরের ডানপাশে ওর রুম। কুশল বিনিময়ের পর ও আমাকে ঘুমাতে বললো। দুজনে শাপলা হোটেলে ঘুমালাম দুপুর গড়িয়ে। হোটেলেই গোসল আর বেয়ারাকে দিয়ে আনা নাস্তা খেয়ে বের হই শাপলা হোটেল থেকে। এই প্রথম এবং এই শেষ আমার সাথে আমাদের বাড়ি এলো ও। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলো। একফাঁকে হোটেলে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বলে- ‘গ্রামে রিস্ক’। আমি আর কিছু বলি না।
ঢাকায় গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হই। ইদানিং মির্জা ফোন ধরছিলোই না, ওর খোঁজ-খবর রানা-র কাছ থেকেই নেয়া আরম্ভ করি। মির্জা রানার সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়। এখনো আছে। তবে মির্জা থেকে রানা একটু আলাদা। কথা কম, উন্নত চিন্তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। কেনো জানি মনে হয়, রানা একটু রাগীও। বড়ো ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে বেশ সম্মান করে। দেখা হলেই খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে আরও একবার গিয়েছিলাম পয়দা গ্রামে। আমি নিজেও তখন খানিকটা অসুস্থ। এক ছোটো ভাইকে সাথে নিয়ে তার মোটর সাইকেলে। ভোরে। বাড়িতে ছিলো না মির্জা। মর্নিং ওয়াকে গেছে। এক সময় এলো। ঘর্মাক্ত। অনেক কথা হলো। রানা-ও বাড়িতে ছিলো। খালাম্মা যথারীতি আপ্যায়ন করলেন আগের মতোই। দুপুরে রানা আর আমরা দু-ভাই একসাথে মোটর সাইকেলে ফিরে এলাম পয়দা থেকে। আর যাই নি।
মির্জা তাহের জামিল বলতে ভালোবাসতেন। আমি যা বলতাম ও সেটার উল্টো বলতো। যুক্তির পর যুক্তি। তারপর আরও আরও আর-ও অনেক যুক্তি। হাসতো প্রায়শই অট্টহাসি। পছন্দ করতো পুরাকীর্তি। সময় ও স্বচ্ছলতা এলেই ভ্রমন করতে চাইতো। পাকশী, নাটোর বেশি যেতো। মন্দীরের পুরাকীর্তি সম্পর্কে আমার কাছে অনেক গল্প করেছে। গল্প করেছে নতুন একটি গল্প সম্পর্কে। আমি বলেছিলাম গল্পটি লিখে আমাকে দেখাবেন। মনে হলো, গল্পটা চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় আছে ওর মনে। আমি অবাক হয়েছিলাম।
ও বলতো, সবাই যেমন লিখতে লিখতে গল্পের ইতি টানে। আমি সেটা করি না। কি লিখবো সেটা আদ্যোপান্ত ঠিক করে নিই। ঠিক করা গল্পটাই লিখি, এক অথবা দুই দিনে। পেন্সিল দিয়ে লিখতে ভালোবাসি। খুব একটা কাটাকাটি হয় না। যেহেতু, কবিতার মতো মুখস্ত করা থিমে গল্প লিখতো তাই পরিণতিটা ওর জানাই থাকতো। রূপকের সাহায্য নিতো গল্পে। শব্দ চয়ন অনেকটা কবিতার মতো। সত্যি কথা বলতে, ওর সাথে দেখা হলে আমাকে নিয়ে এতো সমালোচনা করতো যে আমি আত্মরক্ষা করতেই হিমশিম খেতাম। মেধাবীরা এমনই হয়, পড়েছিলাম। কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে তাকে সরানো যায় না। তবে আমি খুব উপভোগ করতাম ওর সমালোচনাকে। ও যখন দেখতো আমি একদম সারেণ্ডার করে ফেলেছি, তখন আবার আমাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করতো। আহত ইঁদুর নিয়ে বিড়াল যেভাবে খেলা করে, তেমন আর কি! ও চাইতো, আমি আমার লেখা নিয়ে ওর সাথে যুক্তি তর্কে লিপ্ত হই। কিন্তু আমিতো সেই স্বভাবের ছিলাম না কোনো কালেই। কথা বলার ফাঁকে সিগারেট জ্বালিয়ে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দেখা গেলো বলে উঠলো- ‘এ সপ্তাহে তিনটা গান লিখে ফেলেছি। একটা গান লিখেছি দুই মিনিটে।’আমি যদি বলেছি- শোনান দেখি। অমনি বলে উঠতো- ‘আমি কি শিল্পী নাকি ?’ তারপর অট্টহাসি।
আগেই বলেছি, একটা সীমকার্ডসহ ওকে একটা মডেম গিফ্ট করেছিলাম। হঠাৎ যখন সীমকার্ড এর বায়োমেট্রিক নিবন্ধন আরম্ভ হয়, মির্জা সীমটি ওর নামে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করেছিলো। সীমকার্ডটি ফেরত চাইলে বলে- বুদ্ধিটা ভালোই। আমাকে ফাঁসানোর বুদ্ধি আর কী! আমি আর সীমকার্ডটি ফেরত চাই নি।
সন্ধ্যায় মির্জা রানার ফোন পাই। লম্বা করে হ্যালো বলি। ফোনের ওপাশে অন্য পরিবেশ বুঝতে পারি নি। রানা বললো- একটা স্যাড নিউজ আছে। আপনার বন্ধুর ডেথ হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম- শহরে, না গ্রামে? ও বললো- শহরে। আচ্ছা, বলে ফোনের লাইন কেটে থ হয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই।
বাসার সামনে সিঁড়ির পাশে কম্বল মুড়ি দেওয়া মির্জার শবদেহ। কম্বল সরিয়ে চেয়ে থাকি। মনে হচ্ছে বয়সটা অনেক কমে গেছে। চেহারায় মৃত্যু যন্ত্রণার কোনো ছাপ নেই। ঘুমিয়ে আছে যেনো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। ইচ্ছে করছিলো- মুখের উপর কষে একটা চড় মারি। এভাবে কেউ মরে! এতো অভিমান! কার উপর? অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকি। যে লোক আমার গন্ধ পেলেই খলবলিয়ে উঠতো। তার আজ ঘুমিয়ে থাকার দিন।
মির্জা ভালো থাকার অভিনয় করলেও- আসলে, ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। ও যেনো মরে যাওয়ার জন্য জিদ্ ধরে বসেছিলো। আমার সীমকার্ড ফেরত দিলো না ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে। জানে না, সে অনেক আগেই ফেঁসে রয়েছে।
এই মহা-পরিকল্পনা করেছিলো মহামহিম ঈশ্বর মির্জা তাহের জামিলের জন্য!
-
সাগর আল হেলাল
পাবনা, ১১.০৩.২০২২
Post a Comment