চেতনার অপর নাম কাজী নজরুল ইসলাম




আলোহীন অন্ধকার আর অজ্ঞানতার অন্ধকার একই কথা। আলোহীন অন্ধকারে দৃষ্টিসীমা সংকুচিত হয়, অজ্ঞানতার অন্ধকারে মামুলি বিষয়ও সৃষ্টি করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। দিন ও রাতের শরীরের মতোই চোখের শরীরেও রয়েছে আলো ও অন্ধকার। দৃষ্টিহীনতায় অন্ধকার, দৃষ্টিশক্তিতে আলো। আবার দৃষ্টিশক্তিতে দেখা এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর রসাস্বাদন। দৃষ্টিভঙ্গির সামর্থের কারণেই একই সুযোগ সুবিধা নিয়েও একজন হয়ে ওঠেন বরেণ্য, বিশ্বখ্যাত। অন্যজন পড়ে থাকেন সাধারণ্যে। প্রকৃতির রঙ-রূপ-রস-গন্ধ একই থাকা স্বত্ত্বেও এই প্রকৃতিকে অধ্যয়ন করে কেউ হয়ে যান দার্শনিক, কেউ পথভ্রষ্ট।

“আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি”

প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ছোটবেলায় পড়া কবিতাটি আওড়াচ্ছিলাম আর দেখছিলাম রাতের আকাশ। কাছেই যেন নক্ষত্রগুলো। ওখানেই তারা হয়ে আছে পিতা-মাতা। মানুষ মরে গিয়ে কি সত্যি সত্যি তারা হয়ে যায়! কে জানে! নাটক-সিনেমায় শুনেছি। হতেও পারে। মানুষের প্রাণতো দুনিয়াতে থাকতেই বের হয়ে যায়। সে তো স্বাধীন। তাকে আটকানোর শক্তি পৃথিবীর কারো কাছে নেই। আচ্ছা, আত্মা বের হয়ে যায় কোথায়? আমার মৃত্যু হলে, আমিও কি তারা হয়ে যাবো? কী মজা হবে! এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে উড়ে বেড়াবো। সাতটি আকাশ। কোটি কোটি গ্যালাক্সী। এক গ্যালাক্সী থেকে ভ্রমনে যাবো অন্য গ্যালাক্সীতে। বাবা-মাকে খুঁজে পেলে সাথে নেবো। খুব মজা হবে! পৃথিবীর বুকে অভাব অনটনের সংসারে স্বর্থের টানাপোড়নে পারিবারিক সুখ কী, বুঝিনি- মৃত্যুর পরে তারা হয়ে সে সুযোগ পেয়ে গেলে আফসোস থাকবে না। সাধ মিটিয়ে ঘুরে বেড়াবো। পৃথিবীর বুকে আছি, সবাই মুখ ফিরিয়ে থাকলেও- রাতের আকাশে সবাই আমাকে দেখবে। কেমন জব্দ! মনটা পুলকিত হয়ে ওঠে। আবার আকাশে তাকাই। এবার যেন তারাগুলোকে অনেক দূরে মনে হয়। মনে হয় আঁধারেরা তাদেরকে দূ-রে সরিয়ে দিয়েছে। আঁধারে অসুর শক্তি। তাইতো জগতে আঁধার বিতাড়নে এতো আয়োজন। মঙ্গল দ্বীপ প্রজ্জ্বলন থেকে শুরু করে কতো রকমের আয়োজন!

সকাল বেলার পাখি সেই আলোকবর্তিকাবাহী যাদুকর পাখি। নিশ্চয়ই গুরুকবি সকাল বেলা আমাদের ঘুম ভাঙানো দোয়েল, কোয়েল বা রূপকথার কোন পরিযায়ী পাখির কথা বলেন নি! সত্যদর্শী মহান কবি রেখে গেছেন অন্ধকার অসুর শক্তিকে পরাজয়ের সহজ সরল অভিব্যক্তি। কাজী নজরুল ইসলামকে যারা আবিষ্কার করতে পেরেছেন- তারাই জানেন ওনার দর্শনের পরিভাষা। আমরা জানি, যে কোন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনার গুণে লোক-সমাজে সমাদৃত হয়। আসে তার গ্রহণযোগ্যতা, আর তাই তা হয়ে ওঠে অনুকরণ্য। যুগে যুগে এমন শত-সহস্র দার্শনিক এই ভূমণ্ডলে আবির্ভূত হয়েছেন এবং মানুষের কল্যাণে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে গেছেন। খাঁচার মধ্যে একটি বাঘ দেখে আমরা ভেবে থাকি- বাঘের হাত থেকে আমরা নিরাপদ। একইভাবে বাঘও কি ভেবে দেখে না যে, সে মানুষের হাত থেকে নিরাপদ ? বাঘ ও আমি। দু’জনেই খাঁচার বাসিন্দা। দু’জনের মাঝে দুরত্ব কেবল- একটি বিভাজনের দেয়াল। এই দেয়াল ভাঙতে হবে। দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির গড়মিল হলেও, না জেনে না বুঝে বিরোধিতার চেয়ে অধ্যয়নে সচেষ্টা হওয়াই সমীচীন।

সকাল বেলার পাখি হয়ে সবার আগে কুসুম বাগে ডেকে উঠতে চেয়েছেন কবি। কবি’র জাগরণে রাত পোহাবে। এ রাত তথাকথিত রাত নয়, কবি’র বক্তব্য উপস্থাপনের ধরণেই বুঝা যায়। সকাল বা সুব্হে-সাদিকে পাখি হয়ে ডেকে ওঠার অভিব্যাক্তি, একজন মুয়াজ্জিনের সুবহে-সাদিকে মসজিদে আজান দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। দিনারম্ভে কল্যাণ কর্মে আহবান করাই আজানের মূল সুর। এখানে আমরা যদি গতানুগতিক সালাত না ভেবে সত্যিকারের কল্যাণকামী সালাতের কথা ধরি, তাহলে কবিতাটির মহৎ উদ্দেশ্য আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘সকাল’ কথাটিকে কেবল জাগতিক রাত পোহানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখলেই কবিতার মর্মস্পর্শী ভাবধারা বুঝতে আমরা সক্ষম হবে। সুবহে-সাদিক এর অর্থ যদি করা যায়- আমরা জানতে পারি যে, সুবাহ অর্থ আরম্ভ এবং সাদিক অর্থ বিশ্বাসী। অর্থাৎ বিশ্বাসের সূচনাকেও সকাল বলা হয়। বিশ্বাস বহু প্রকারের রয়েছে। আত্মবিশ্বাস কি বিশ্বাস নয় ?

কবি কুসুমবাগের কথা বলেছেন। কুসুমের সাধারণ অর্থ কলি বা কুড়ি। আমরা জানি, কলি বা কুঁড়ি হচ্ছে- একটি ফুল তথা একটি ফল তথা একটি বৃক্ষ। ফুলে যেমন কুঁড়ি থাকে, ডিমে থাকে কুসুম। এখানেও সেই সৃষ্টির উৎসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কবি যথার্থভাবেই, প্রতিটি আরম্ভের মূলে নিজের উপস্থিতির ঘোষণা দিয়েছেন। লালন সাঁইজী বলেছেন- ইল্লতে স্বভাব হলে, পানিতে যাবে ধুলে- খাসলতি কিসে ধুবা’। এই খাসলতি দূর করতে হলে কুসুমকলিতে সংশোধন আনতে হবে।

সত্যদর্শী কবি কুসুমকলিতে তাঁর উপস্থিতির ঘোষনা দিয়েছেন। কবি সহজিয়া ভাষায় আরও অনেক কথাই বলেছেন এই কবিতায়। সর্বংসহা ধরিত্রী মায়ের অসীম মমতার কথা তুলে ধরেছেন। মা যেমন সন্তানের প্রশান্তির আশায় ঘুম-পাড়ানি গানে আঁচল ছায়ে বেধে রাখেন, জগদ্জননীও একই রূপে তার সন্তানদের অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়াবাড়ি ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত স্থাপনে সচেষ্ট রয়েছে এটাই তিনি তুলে ধরেছেন। মা বলেছেন- এখনো সকাল হয় নি, অশিক্ষার অন্ধকারে এখনো তলিয়ে আছে জাতি, সত্য গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নয় তারা। কবি মায়ের ক্ষমা সুন্দর মনের সাথে এতটুকু বিতর্ক করেন নি! বরং এ সময় তিনি মায়ের কাছেই উল্টো প্রশ্ন রেখেছেন- আমরা না জাগলে সকাল হবে কি করে? প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি গোটা জাতিকে জড়িয়ে নিয়েছেন। যে জাতি তার নিজের মঙ্গল চায় না, ঈশ্বরও তার মঙ্গল করেন না। এমন কথাইতো শোনা যায়!

কবি এই কবিতায় আমি এবং আমরা বিষয়টিকে চরম উৎকর্ষে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন। এক থেকে সমষ্টিতে এবং সমষ্টি থেকে আবার একের মধ্যে ফিরে এসেছেন। এক ও এককের সম্পুরক ও পরিপূরক চলনের নান্দনিক উদাহরণও সৃষ্টি করেছেন তিনি। লক্ষ কোটি অণুজীবের সমন্বয়ে গঠিত মানব দেহের একটি অণুজীবও যদি কষ্ট পায়, তার যন্ত্রণা সারা দেহ অনুভব করে। একটি দেহের জেগে ওঠার সাথে কোটি অণুজীবের জেগে ওঠার সম্পর্ক রয়েছে। কান টানলে মাথা আসে, আর মাথা আসলে ধরও আসে। সমাজকে কবি এখানে মানুষের দেহের সাথে তুলনা করেছেন। সমাজের প্রতিটি মানুষ এক-একটি আমি, অনেকগুলো আমি-কে নিয়ে আমরা। কবি স্বার্থপরতার অনেক ঊর্দ্ধে উঠে নিজেকে সকলের সাথে জোড়া দিয়ে, পুরো সমাজের জেগে ওঠার কথা বলেছেন। আর এই জেগে ওঠা কেবল ঘুম থেকে জেগে ওঠাই নয়-অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, কু-সংস্কার ইত্যাদি পরিহার করে মানবীয় দায়িত্বে ফিরে আসার কথা বলেছেন তিনি। তিনি প্রত্যেকের মধ্যে সুপ্ত মানুষ স্বত্ত্বার ঘুম ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন।

আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে তো মা রাত পোহাবে তবে।

সমগ্র সমাজ না জাগলে কল্যাণের সূচনা হবে কি করে ? কবি আশঙ্কা ব্যক্ত করার সাথে সাথেই আবার চরম দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে নিজের প্রতিনিধিত্বের ঘোষণা দিয়েছেন। মাকে আশ্বস্ত করেছেন- তিনি উঠলেই রাত পোহাবে।

আমরা ভুলে গেছি মনুষত্বের পরিচয়। দায়িত্ব, কর্তব্য কি সে সব যেন মনে পড়ে না। না পরি নিজের সাথে কথা বলতে, না পারি সমাজের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে। প্রতিটি কাজে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে করতে হতাশার অতল গহ্বরে ঘুমিয়ে গেছে আমাদের আমিত্ব। আমরা কি জাগতে পারি না ? পারি না অন্যকে জাগাতে ? প্রিয় কবি’র কবিতার শেষ দুটি চরণ আওড়াতে গিয়ে চোখ দুটি ভিজে গেলো। আমাদের সকলকে আগামীকাল থেকেই সকল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে প্রতিটি বিষয়ের ইতিবাচক ও কল্যাণকামী ভাবধারাকে জাগিয়ে তুলে মানুষের সামনে তুলে ধরে সমাজে সংস্কার আনতে হবে। আমরা যদি তা করতে পারি, তাহলেই হয়তো সফলকাম হতে পারবো। সময়ের দাবীও সেটাই।
-

সাগর আল হেলাল
কলামিস্ট
৮.৪.২০২২
===========

Post a Comment

Previous Post Next Post