দুঃখের শেঁকড়ে বিস্ময়কর সুখ





সাগর আল হেলাল

================


কলকাতা থেকে আরতি দেবীর বন্ধুরা এসেছেন। বাড়িতে অনুষ্ঠানের আমেজ। বাবুর্চীরা আজ সাজ-সজ্জা করে এসেছে। আয়া-বুয়ারাও পরেছে পরিচ্ছন্ন পোশাক। চারুলতা আর বাদ যাবে কেমনে। অঙ্গে গহনা না থাকলেও অষ্টাদশীর শারীরিক গয়নার কমতি ছিলো না জোয়ার উপচানো নদীর মতোই তার যৌবন। কপালে দুই ভ্রুর মাঝখানে পরেছে একটি কালো টিপ, চোখে এঁকেছে কাজলের রেখা। এতেই অপ্সরী লাগছে চারুকলাকে। তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে লতা মাসি।


বয়সে চারুলতার থাকার কথা স্বামীর সোহাগে। বিধাতার ইচ্ছা বিধাতাই জানেন। মা দুর্গা, হতভাগীরে রক্ষা করো, সুমতি দাও। চারুলতা লতা মাসির দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হাসে। চোখ নাচায়। ভেতর বাড়ির বড়ো কাঁচের আয়নায় নিজেকে দেখেছে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলো কিছুক্ষণ। তার শরীরে এতো রূপ! জন্যই জানোয়ারগুলো অমন কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আবার মনে মনে পুলকিতও হয়। জানোয়ারগুলোর চোখের ঘুম হারাম করার ক্ষমতা মা কালী তাকে দিয়েছেন। ভেতরে অন্যরকম একটা শক্তির উপস্থিতি অনুভব করে। জানোয়ারগুলোকে কল্পনায় দেখতে পেয়ে আপন মনে বলে- আমি মা কালীর ভক্ত। মায়ের আরেক নাম চণ্ডী। যেদিন সুযোগ পামু, কল্লা নামায়া দিমু।


লতা মাসির চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে চারুলতা। স্বাভাবিক হাসি হেসে কাছে সরে আসে। ফিস ফিস করে বলে-


- তোমার সুবলের আজ খবর আছে। রূপের আগুনে আজ ওকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো। আজ তার রক্ষা নেই !


- পোড়ামুখি কি সাধে বলি তোকে ! অমন ভালো ছেলেটাকে নিয়ে কি খারাপ খারাপ চিন্তা তোর ! বলি সাবধান ! আরতি দেবীকে তুই চিনিস না। একবার যদি তার মনে ঘুণ ধরে, তোর পেটের নাড়ি-ভূড়ি চিড়ে সব কথা বের করে নেবে। ছেলেটারও হয়তো চাকরীটা থাকবে না। খবরদার, তার সামনে মাথা উঁচু করে পা ফেলবি না !


বড়ো লোকের কায়কারবার বলে কথা। তারা ঘড়ির সাথে চলাফেরা করে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন আরতি দেবী। ওনার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতেই কাটিয়েছেন অর্ধেক বেলা। যথা সময়ে দুপুরের খাবার বিকালের নাস্তা সেরেছেন। সন্ধ্যেবেলা অন্য এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছেন সদলবলে। কখোন ফিরবেন তার ঠিক নেই। লতা মাসি বা চারুকলার কোন কাজ নেই। এই ফাঁকে আরম্ভ হয়েছে লতামাসির শাসন পর্ব।


নানান কাজের ফাঁকেও লতা মাসির দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো আজ চারুলতার উপর। সুবলকে সে দ্যাখেনি আশে পাশে। নিজের উপর রাগ হয় তার। কী যে সর্বনাশা মায়ারোগ ওর! তা না হলে সুবলও তার কেউ নয়, চারুলতাও তার সাত কূলের কেউ না। তারপরও তাদের জন্য এতো মায়া কেন তার ? যা খুশি ওরা করুক, তাতে তার কি ? ওরা চাকরী হারালে বা ওদের কোন শাস্তি হলে তার কিছুই আসে যায় না ! তারপরও কেন তার এতো দুশ্চিন্তা ওদের নিয়ে? চারুলতার প্রতি তার স্নেহের মাত্রা যাতে বেড়ে না যায়, সে জন্য সে ইচ্ছে করেই চারুলতার সাথে বাজে ভাষায় কথা বার্তা বলে। চারুলতাকে সে পছন্দ করে বা ভালোবাসে এটা সে বুঝতে দিতে চায় না তাকে। লতা মাসিকে আনমনা দেখে চারুলতা জড়িয়ে ধরে তাকে। তার গালে একটা চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করে-


- কি যেন কইতাছিলা তুমি ?


- মাগীর কাম দেখো ! আমি কি ছাগল-ভেড়া নাকি যে, চুমু দিতাছিস ! সাবধান চারু, আগুনে ঝাঁপ দিস না !


- আইচ্ছা ! দেখা যাবেক্ষণ। কিন্তু, তোমার ভালো ছেলেটা গেলো কোথায় ? দেখছি না যে ! আমাকে এতো শাসাচ্ছো যে, তাকেও বলে দিও- সে যেন আমায় একটু করুণা করে। এক নজর দেখা দেয়! ওর জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। আজ যদি দেখা না দেয়, রাতের বেলা আমি ওর ঘরে ঢুকে যাবো, এই আমি বলে দিলাম। বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে যায় চারুলতা।


চারুলতার যাবার পথের দিকে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লতা মাসি। তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে চারুলতার এমন বলিষ্ঠ কথা বার্তায়। পোড়ামুখি সত্যিকারের প্রেমে পড়েছে। ওকে পথ থেকে কেউ আর ফেরাতে পারবে না। কেন যে এতোটা ভালো হতে গেলো সুবল!

-

৬.৪.২০২২


চলবে-


Post a Comment

Previous Post Next Post