দুঃখের শেঁকড়ে বিস্ময়কর সুখ

 



চারুলতার বিনিদ্র দুটি চোখ আটকে আছে পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলার জানালায়। ঐ ঘরে সুবল থাকে। সে কি জেগে আছে তারই মতো ! নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে অনাড়ী? সুবলকে আনাড়ীর মতোই মনে হয় চারুলতার। ভূমিষ্টের পর একটি শিশু যেমন নিষ্পাপ, কোমল থাকে- সুবলও তেমনই। কোন কাজে তার না নেই, অবজ্ঞা নেই। চোখ দুটিতে কেবলই সমীহ, গভীর সহমর্মিতা সর্বোপরি নিখাদ ভালোবাসা।
- ও মাসি, ঘুমাইছো ?
চারুলতার পাশে শুয়ে থাকা তার একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী লতা মাসি। গায়ে ধাক্কা দিয়ে আবার তাকে জিজ্ঞেস করে-
- ও মাসি, ঘুমাইছো ?
- উমমমমমম !
- মাসি ? কওনা, ঘুমাইছো ?
- রাইত হইলো ঘুমানোর লাইগা। ঘুমামু না তো কি করুম ?
- একটা কথা কইবা ?
লতা মাসি সাড়া দেয় না। তার চোখে ঘুমের আবেশ। সারাদিন পরিশ্রমের পর বুড়ি মানুষটার চোখে ঘুম আসারই কথা। চারুলতার সন্দেহ লাগে। ঘুমিয়ে গেলো নাকি !
- ও মাসি ! কও না, একটা কথা কইবা ?
- ছেনালি করিসনেতো চারু ! ঘুমাইবার দে !
- কথাখান না শুনলে ঘুমাইবার দিমু না ! আমার নাই চোখে ঘুম ! বুড়ি খানকি আরামে ঘুমাইবো। ঐ বুড়ি, তোর বুঝি যোয়ান কাল আছিলো না !
বয়স বাড়লে মানুষের দায়িত্বও বাড়ে। তাছাড়া, চারুলতাকে সে-ই এই বাড়িতে এনেছে। চারুলতার অস্থিরতা তাকে স্পর্শ করে। চারুলতার দিকে পাশ ফিরে শোয় লতা মাসি। ঘুম ঘুম চোখে বলে-
- বল ছেমড়ি, কোন কথা ?
- সুবলরে তোমার কেমন মনে হয় ?
- ভালোইতো !
- অমন ছ্যাড়াব্যাড়া না। আসলে কেমন মনে হয় ? ওরে কি তোমার ফাঁকীবাজ মনে হয় ?
নিমেষে যেন উড়ে যায় লতামাসির চোখের ঘুম। কেটে যায় বার্ধক্যের জড়তা। লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ে। চোর-ডাকাতের হানা পড়লে মানুষ যেমন অস্থির হয়ে যায়। লতা মাসিও যেন তেমন অস্থির হয়ে গেছে। চারুলতাও উঠে বসে। লতা মাসি চারুলতার শরীর স্পর্শ করে। পেটে হাত দিয়ে বলো-
- কিছু করে বসিস নিতো পোড়ামুখী ?
চারুলতা মুখে হাত চেপে খিলখিল হাসে। পেটের উপর রাখা লতা মাসির হাত টেনে নিয়ে বুকের বাম পাশে চেপে ধরে। বলে-
- ওখানে না মাসি, এই খানে। দ্যাখো তোমার ঐ বজ্জাত ছেলেটা এখানে কতো জোরে জোরে গুতাইতাছে।
- চুপ কর ছেড়ি ! তোর মতো না ও। ও খুব ভালো ছেলে। কাইল যদি ওর আশে পাশে তোরে দেখছি, তাইলে- তোর একদিন না আমার একদিন দেখায়া ছাড়মু। এইবার ঘুমা। বেশি রাইত জাগলি সকালে ঘুম ভাঙবো না।
লতা মাসি শুয়ে পড়ে আবার। নিশ্চিন্ত হয়েছে, এখনো তেমন কিছু হয়নি। তবে হতে কতোক্ষণ ! বিষয়টা আগেই আরতি দেবীকে জানানো যাবে না। তিনি আবার যেই রাগী মানুষ। দুইটার উপর নজরদারী করতে হবে। সুবল একটি ভালো ছেলে তাতে তার কোন সন্দেহ নেই। তবে বয়সকাল বলে একটা কথা আছে। গায়ের কাঁথা টেনে নিয়ে দুর্গা দুর্গা বলতে বলতে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
লতা মাসি শুয়ে পড়ার পরও কিছুক্ষণ বসে থাকে চারুলতা। লতা মাসির কথায় সুবলের ভালো মানুষির আরও একটা দলিল পেয়েছে সে। চোখদুটি তার চকচক করে ওঠে। বাছা তুমি যাবে কই ! দোতলার জানালায় তখনো আলো দেখা যাচ্ছিলো।
-
চলবে-
৬.৪.২২


Post a Comment

Previous Post Next Post