দুঃখের শেঁকড়ে বিষ্ময়কর সুখ

 

সাগর আল হেলাল

লতা মাসি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে চারুলতাকে জাগিয়ে দেয়। তারপর তৈরী হয়ে নিজে আগে যায়, ওকে যেতে বলে ধীরে সুস্থ্যে। একজন মা যেমন চায় না তার সন্তান বেশি পরিশ্রম করুক বা একটু বিশ্রামে থাকুক, এ যেন তেমনই এক রহস্যময় সম্পর্ক ওদের দু’জনের মধ্যে। লতা মাসি তার স্নেহের ধারাকে আড়াল করতে আজে বাজে ভাষায় কথা বলে। চারুলতা কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পেয়েও লাগামহীন জ্বালাতন করে। সে জানে, লতা মাসি তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও ভেতরটা তার অনেক নরম। লতামাসি আজ তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় নি, তাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিলো। বিষয়টি কি ! আড়মোড়া ভেঙে বিছানা গোছাতে ব্যস্ত হয় চারুলতা। লতা মাসি অগোছালো ঘর একদম পছন্দ করে না। বলে- পরের ঘর যদি গুছিয়ে দিতে পারি, আমার ঘর অগোছালো থাকবে কেন ? আমার ঘর ! চারুলতার বুক ভেঙে এক দীর্ঘ হাহাকার বের হয়ে আসে। ঘর লাগোয়া কলপাড় থেকে মুখে মাথায় জলের ছিটা দিয়ে ফিরে আসে ঘরে। গা-টা শীত শীত করছে। কাজে যাওয়ার আগে গোসল করে যেতে হবে। গোসল ছাড়া আরতি দেবীর বসবাসের এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ।

গোসলের কাপড়-চোপড় কোলের উপর রেখে চোখ রগড়ায় চারুলতা। অনেক ক্লান্তি লাগছে তার। রাতে খায় নি। কিন্তু আগে তো তিন দিন তিন রাত না খেয়েও এমন ক্লান্তি আসে নি ! আজ কেন এমন হলো ! মন ও শরীর কি তাহলে এক সুতোয় বাঁধা ? এমনই সাত-পাঁচ ভাবছিলো চারুলতা। ঘরে ঢোকে লতা মাসি।
- কি রে, উঠছস ?
- আজ যে বড়ো দরদ দেখায়া কথা কইতাছো ? মাগী, ছেনাল ছাড়া কথা কওনা। তোমার এই মন ভুলানো ভালো মানুষি কথা আমি বুঝি না মনে করছো !
- চেতস ক্যা বজ্জাত মাইয়া ? আমি কি এমন মায়া দেখাইলাম তোরে ?
- মনে করছো- আমি কথার ভাও বুঝি না ? যাইতাছি, আমার চান করতে দুই মিনিটও লাগবে না। কি কাম করা লাগবে ক’য়ে দেও। ওতেই আমি খুশি।
- এখন আর তোর যাওয়া লাগবে না। আরতি দেবী তার বন্ধুদের নিয়ে কালই নারায়ণগঞ্জ গেছে। রাতে ফেরেনি। বাইরের কাজ যেটুকু ছিলো আমিই সেরে এসেছি। সুবল বাজারে গেছে রাতের জন্য বাজার করতে। সর দেখি, শরীরটাকে একটু আরাম দি। দুর্গা, দুর্গা !

খালি চৌকির উপর চারুলতাকে পাশ কাটিয়ে শুয়ে পড়ে লতা মাসি। সুবলের নাম শোনার সাথে সাথে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায় ওর। নিজেকে প্রশ্ন করে- কিছু বলবে মাসিকে ! নাহ্ একটু আরাম করুক। এই বয়সে অনেক ধকল সইতে হয় তাকে। এতো বড়ো বাড়ি, আট-দশ জন চাকর-বাকর সবার দেখভাল করে এই বুড়ি মানুষটা। কারো বেতন বাড়ানোর সুপারিশও এই বুড়িই করে থাকে। তার সুপারিশ ছাড়া কারো আবেদন মঞ্জুর হয়না। মঞ্জুর করেন না আরতি দেবী। লতা মাসির সুপারিশেই তার ঠাঁই হয়েছে এ বাড়িতে। মাসির ঐ এক কথা, মাইনে যা-ই দেন- অসুবিধা নাই। মেয়েটার নিরাপত্তা দরকার। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই আরতি দেবী তাকে চাকরীটা দিয়েছেন। একটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কোলের উপর রাখা গোসলের কাপড়-চোপড় নিয়ে চারুলতা স্নানের উদ্দেশে কলপাড়ের দিকে পা বাড়ায়।

স্নান সেরে ঘরে এসে চারুলতা অবাক। যে মানুষ বিশ্রাম করার জন্য শুয়ে পড়লো, সে এখন চৌকিতে বসে পান চিবুচ্ছে ! যেন মহা আনন্দে আছে। বুড়ির মতলব কি ! গতরাতে সে তার মনের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলেছে, তাই কি সে মজা নিচ্ছে ! বুড়ির পেছনের ইতিহাস কিছুই জানে না চারুলতা। কিন্তু, লতা মাসি তার জন্য দেবী সমতূল্য। সে-ই তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে এবং এখানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। লতা মাসিকে এতো শ্রদ্ধা করে তা বুঝতে দিতে চায় না চারুলতা। কারো স্নেহের, ভালোবাসার সুযোগ নেওয়া ঠিক নয়। যদি জীবনে তেমন দিন আসে, তাহলে সেদিন তার পাশে দাঁড়িয়ে ঋণশোধের চেষ্টা করাই যথার্থ মনুষ্যত্বের কাজ। চারুলতা সেটাই মনে করে। আর তাই, লতা মাসিকে ও ভাবে পান চিবাতে দেখে বলে ওঠে-
- ঐ বুড়ি, তোমার নাকি শরীর বিষ করে ? শরীরটাকে আরাম দেওয়ার লাইগা শুইলা, অহন আবার দেখি মজা মাইরা পান চিবাইতাছো- মতলবটা কি ?
- মতলব আবার কি ! আমার পান খাওনের হিসাবও কি তোরে দিতে হইবো ? ঐ ছেমড়ি, কথায় কথায় তুই আমারে বুড়ি ক’স ক্যান ! তোর মতলবটা কি, তাই বল আগে।
- বুড়ি নাতো কি তোমায় ছেমড়ি ক’বো ! ইশ্ ছেমড়ি সাজার শখ কতো ! বুড়ি ছেমড়ি !

লতা মাসি কিছু বলে না। চারুলতার মনটাকে সে হালকা করতে চায়। গতরাতের ঘটনা তার মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। বয়স আর অভিজ্ঞতার জোরে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে সে। না হলে সে-ও ভেঙ্গে পড়তো। তেমন কিছু হয়ে গেলে সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকতো না। চারুলতার এখনকার কথা-বার্তা শুনে মনে মনে খুশি হয় সে। আপাতত মেঘ কেটে গেছে। কিন্তু সে জানে না, মেঘ নয়- তার সামনে তুফান অপেক্ষা করছে।

ঘরে ভেতরেই কাপড় মেলে চারুলতা। এটাই ওদের অভ্যাস এবং নিয়ম। কাপড় মেলার ফাঁকে ফাঁকে লতা মাসির মনের মতি গতি বুঝার চেষ্টা করে সে। ভাবে, আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে বুড়িটা। তাকে হাত না করলে চারুলতার মনের আশা কোনদিন পূরণ হবে না। এ কথা সে ভালো করেই জানে এবং বুঝেও। এই বুড়ির অজ্ঞাতে এখানের গাছের পাতারাও এক স্থান থেকে সরে অন্য স্থানে যায় না। তাকে রাজী করাতেই হবে। তবে ছলনার আশ্রয় নিতে চায় না চারুলতা। সে চায় না, লতা মাসি কোন অসম্মানে পড়ুক। কাপড় মেলা শেষ করে চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসা লতা মাসির পায়ের কাছে শানের উপর বসে পড়ে। হাত দুটি মাসির হাঁটুর উপর রেখে তাতে মাথা রেখে খুব ক্ষীণ স্বরে বলে-
- মাসি, তুমি আমার উপর রাগ করছো ? তোমার গালি দেওয়া কথার মধ্যে কতো ভালোবাসা আছে, তা আমি জানি। তোমার আজকের এই মিষ্টি আচরণে আমার ভয় হয়, তুমি আমার উপর রাগ করো নি তো !
- নারে, রাগ করবো কেন ? আমিওতো মানুষ। আমার মধ্যেও মানবিকতা আছে ! আমার মধ্যেও হাসি আছে, কান্না আছে। হাসি-কান্নার ভিতরেই বয়ে যায় জীবনের নদী।
- তোমার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না মাসি। যতটুকু জানি তুমি আমায় সন্তানের মতোই ভালোবাসো। আমিও তোমায় মায়ের মতোই মনে করি !
- তোর গালি শোনার খুব শখ হইছে, না ? আমার লগে ফাইজলামি ! দাঁত-চোপা ভাইঙ্গা ঘরে ফালাইয়া রাখুম !
- তাই ফালাও। কোন দুঃখ নাই। শুধু একবার তোমার সুবলের লগে আমার দেখা করাইয়া দেও। সে যে আমার দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। কাছে গিয়া আমি তারে জিগাইবার চাই- কিসে এতো অহংকার তার !
- চারুলতা, ভুলে যাইসনে- তোরে কেউ নষ্ট করছে।
- মাসি তোমার পায়ে পড়ি। ঐ কথা তুমি কইও না। ঐ হারামী বিশু বেপারী আমায় নষ্ট করতে পারে নাই ! কুত্তার মতো খালি ঘাড়ে গলায় লালা ঝরিয়েছে। আজো মনে পড়লে গা ঘিন ঘিন করে ওঠে।
- তাইলে ? এই নষ্ট শরীরটা তুই ওরে কিভাবে দিবি। যে কথা আজও তুই ভুলতে পারিস নাই, সে কথা কি এ জীবনে ভুলতে পারবি ? কোনদিন পারবি না। সুবলের কথা তুই ভুলে যা, এতেই তোর মঙ্গল।
- মন যে মানে না মাসি !
- মনেরে মানাতেই হইবো। এ ছাড়া কোন পথ নাই।
- তাইলে মাসি, আমার মনটারেই তারে দিতে দেও। এই নষ্ট শরীরের দাবী কোনদিন তার কাছে রাখবো না। সে আমার মন নিয়েছে, এ টুকু শান্তি নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেবো আমি।
- এ কি সর্বনাশা কথা তোর ! যে আগুনে আজ তুই জ্বলছিস, আমার সুবলও যে সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তাহলে !
- তাইলে আমি কি করবো মাসি !
চারুলতা রাতের মতো একইভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। লতামাসি কি করবে ভেবে পায় না। হীর-রাঞ্ঝা, চণ্ডীদাস-রজকিনীর প্রেম কাহিনী কেচ্ছাতে শুনেছে। কিন্তু চারুলতার মনে এ আবার কেমন পিরিতি ! চারুলতার কান্না তার মাতৃ হৃদয়ে বেদনার ঝড় বয়ে দিয়ে যায়। ও দিকে সুবল কার ঘরের ছেলে, কি তার বংশ পরিচয় তা-ও জানে না লতামাসি। কিন্তু আদব-কায়দা, চলা-ফেরা, কথা-বার্তায় সে-ও লতা মাসির মনে সন্তানের মতো জায়গা করে নিয়েছে। এক সন্তানের সুখের জন্য সে অন্য সন্তানের অমঙ্গল কিছুতেই ডেকে আনতে পারবে না সে ! চারুলতার মাথায় হাত বুলায় লতা মাসি। চারুলতা গুঙিয়ে গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে। অশ্রু নদীর বাঁধ আজ ভেঙে গেছে তার।
-
৬.৪.২২

চলবে-

Post a Comment

Previous Post Next Post