দুঃখের শেঁকড়ে বিষ্ময়কর সুখ

 

পর্ব-১১

 

রান্না ঘরের এমন এক জায়গায় দাড়িয়েছে চারুলতা, যেখান থেকে বাজার নিয়ে আসা সুবলকে খুব ভালোভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সুবল তাকে দেখতে পাবে না। লতা মাসি বিষয়টা জেনে বুঝেও হাঙ্গামা করছে না। আরও কাজের লোক আছে, যারা বাইরে থেকে আসে। চুপচাপ হাতের কাজ করে যায়। এক ফাঁকে চারুলতার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বুঝাতে চায়, বাড়াবাড়ি যেনো না করে সে। চারুলতাও কম যায় না। মাসির দিকে তাকিয়ে জিহবা বের করে ভেঙচি কাটে। আর মিটমিট করে হাসে। 

-  মাসি, কই তুমি? বাজার আইসা গেছে। সুবল দুই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।

- এই তো বাছা। দেও, ব্যাগ দুইডা আমার কাছে দেও। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় লতামাসি। ইচ্ছে, চারুলতা যাতে সুবলের সাথে কথা বলতে না পারে।

-     তুমি পারবা না মাসি! ব্যাগ খুব ভারী। ব্যাগ দুইটা আসলেও বেশ ভারি ছিলো। সুবল একেবারে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।

সুবল চারুলতাকে দেখছে না। চারুলতার চোখ ফিরছে না সুবলের চেহারা থেকে। সুবল ক্যাবলার মতো কথা বললেও আসলে চারুলতা বিশ^াস করে না যে, সুবল কোনো ক্যাবলা ছেলে। প্রতিটি কাজ করে নিখুঁতভাবে। বাজারে গিয়ে কোনো দিন কোনো সওদার কথা সে ভুলে যায় না। পঁই পঁই করে হিসেব মিলিয়ে দেয়। চেহারায় মার্জিতের ভাব আছে। কিন্তু গোবেচারা সেজে থাকে। ব্যাগ থেকে বাজার ঢালতে ঢালতে বলে-

- আচ্ছা, বাছা! ইবার তুমি ইকটু জেরোৗ গা। আমি দেখে নিচ্ছি। কথা বলে সে ভিতরে থাকা চারুলতার দিকে আড়চোখে তাকায়। চারুলতা হাতে কিল দেখায়। লতা মাসি উপভোগ করে সকল বিষয়। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না।

- তোমার পান সুপুড়ি ঐ দুই নম্বর ব্যাগে আছে। বলে সুবল।

-     আমিতো তোমায় পান আনতে বলি নি বাছা! পয়সাও দো দিই নি?

-     ও আমি ব্যবস্থা করে নিয়ে আইছি। যেই আমার আষ্ট আনার পান-সুপুড়ি!

-     ট্যাহা পয়সা চুরি কইরো না সুবল। আরতী দেবী এগুলা পছন্দ করে না। তুমি বরং আমার কাছ থেকে পয়সাডা নিয় নেও।

-     আরে না মাসি। তোমার পানের পয়সা আমার থেইকে দিয়েছি। আরতী দেবী আমাকে হাত খরচের জন্যি পাঁচটা টাকা আলাদা করে দিয়েছিলেন।

-     তুমি আবার আমার জন্যি পয়সা খরচ করতি গেলে ক্যা?

- এইখানে তো আমার আর কেউ নাই। মনে হইছে, তাই আনছি। তুমি অন্য কিছু মনে কইরে না।

সুবল আর মাসির কথা বেড়ে যাওয়ায় চারুলতার সুবিধেই হলো। এতো কাছ থেকে এতোক্ষণ ধরে সুবলকে দেখার সুযোগ সে পায় নি। চারুকে দেখলেই সে যেনো নার্ভাস হয়ে যায়। যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় সটকে পড়ে। কথা বলা তো দূরে থাক চোখের দিকে সরাসরি তাকায়ও না।

বসন্তেু কোকিল ডাকে। কোকিল বুঝে কি করে বসন্ত এসেছে? বাতাস তাকে বলে দেয়। বলে দেয় ভ্রমরের গুঞ্জন, ফুলের বাহার। রান্না ঘরের ভেতর চারুলতা আছে, কথা যেনো বাতাস বলে দিচ্ছিলো সুবলের কানে কানে। সুবল আজ যেনো চারুকে দেখতে চায়। ভেতরের মার্জিত সুবলকে দেখাতে চায় চারুলতাকে। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে বলে কিছু বলে না। হৃদয়ের কোণে দোলা লাগে। চারুলতার ¯িœগ্ন নারীসূলভ গন্ধ লাগে সুবলের নাকে। সুবল মোহিত হয় সেই সুগন্ধে। কিন্তু প্রকাশ করে না কিছুই। বাজার বুঝিয়ে দিয়ে, বাজারের ফর্দ হাতে নিয়ে লতা মাসি কে উদ্দেশ করে বলে-

-  যাই মাসী, হিসেবটা বুঝিয়ে দিয়ে আসি।

-     ঠিক আছে। নাস্তা তোমার ঘরে দিয়া আছে। হাত-মুখ ধয়ে খেইয়ে নেও গে। মাছটা মাটির গামলায় রাখতে রাখতে বলে লতামাসি।

সুবল চলে যেতেই সামনে বের হয়ে আসে চারুলতা। লতামাসিকে জড়িয়ে ধরে বলে- কেমুন ঘামতাছিলো! মনে অয় আমারে দেইখ্যা ফালাইছে। লতামাসি কিছু বলে না, মনে মনে হাসে। তার নিজের যৌবন বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। চারুলতার আবেগ, শুধু চারুলতার নিজের আবেগ নয়। আবেগ ষোলো বছর ছোঁয়া সকল নারীর। নারীর এই আবেগ চিরন্তন। কেবল প্রকাশ ভঙ্গি আলাদা। লতামাসি চারুর হাতে পান-সুপাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলে- এটা ঘরে রাইখে আয়। আরতী দেবী মাছ দেহার জন্যি এহনই আইস্যে পড়বিনি।

- দেও। পান খাইয়ে ঠোঁট লাল করি গে। লতামাসির হাত থেকে পান-সুপাড়ি নিয়ে যেতে যেতে বলে চারুলতা।

 

-

চলবে-

 

সাগর আল হেলাল

১৬.০৪.২০২২


Post a Comment

أحدث أقدم