অণুগল্পঃ বাবলা কাঁটা

আমার মাধ্যমিক স্কুলের নাম দড়ি ভাউডাঙ্গা বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়। নবম শ্রেণিতে পড়ি। লেখা-লেখি করি। বুঝতেই পারছেন, নবম শ্রেণি এবং কবি (!), না জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্য জীবনে এমন স্মৃতি আছে কি না ! ততদিনে আমার মেজ কাকা এক কিশোর কবির কবি প্রতিভা নিয়ে নানা ধরণের রসালো মন্তব্য বাজারে চালু করে দিয়েছেন (দু:খিত কাকা)। তিনি আমার সমবয়েসীদের ডেকে বলতেন- এই তোরা শুনেছিস্ নাকি ? আমাদের হেলাল তো কবি হয়ে গেছে ! আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, আর ভাব এলেই কবিতা লেখে ! আমার সাথে দেখা হলে- ওরা চুপি চুপি এসব কথা আমায় বলে দিতো। আমি খুব রেগে যেতাম। বলতাম- শালার কবি হয়ে দেখায়ে দেবো ! 

আমার স্কুলটা বাড়ি থেকে প্রায় ৪ মাইল দূরে। হেঁটেই যেতাম। সেদিনও যাচ্ছিলাম প্রতিদিনের মতো। একা হাঁটতে আর ভাবতে আমার খুব ভালো লাগতো তখন থেকেই। এখনও যেমন। কলেজের বন্ধুরা আমাকে ডাকতো- লাজুক বন্ধু বলে। এতে আমি রাগতাম না। আমি মনে করতাম লজ্জা-শরম মেয়েদের থাক আর না-ই থাক, পুরুষের থাকা চাই-ই চাই। তো, স্কুলে যাবার পথে যেন একটি কবিতার প্লট এসে আমাকে গ্রাস করে ফেললো। চলতে পথে তো আর লেখা যায় না ! স্কুলে যাওয়ার কথা ভুলে বসে পড়লাম রাস্তার ধারের বাবলা গাছের ছায়ায়। বাবলা গাছে তেতুঁল পাতার ধরণের খুব মিহি আকারের পাতা হয়। যেন নাজির শাল চাল। পাতাগুলো দাঁতে চিবালে কেমন কস কস লাগে। কিন্তু এরপর পানি খেতে খুব মিষ্টি লাগে। পানি খাওয়ার প্রতিযোগিতা লাগলে বাবলা পাতা চিবিয়ে তারপর কল চেপে এক কল পানি খেতাম। কে কয় কল খেতে পারে তা-ই হতো প্রতিযোগিতা। হেরে গেলে বই টানতে হতো। যে জিততো সে আগে আগে হাত ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে গান গেয়ে গেয়ে চলতো। যেন লাট সাহেবের বেটা। 

হলুদ রঙের গোল গোল ফুল হয় বাবলা গাছে। গাঁদা ফুলের মতো। খুব খুব খুব সুন্দর দেখতে। বান্ধবীরা কানের দুল বানাতো বাবলা ফুলে। আর কবি তো আছেই। বাবলা ফুলে কবিতা রচিত হয়ে যেতো। তবে কিনা এই বাবলা গাছের কাঁটাও আছে। এক্কেবারে লেপ সেলাই করা সুঁচ যেমন, তেমন। বিঁধলে আর রক্ষা নেই। বের করলে রক্ত বের হতো এবং কয়েকদিন ব্যথা থাকতো। বাবলা কাঁটার কথা মনে হলে, এখনো গা শিউরে ওঠে। আমি যেখানে বসে কবিতা লিখছিলাম, তার সামনে বাবলার কাঁটাযুক্ত অনেকগুলো ডাল কাটা অবস্থায় রাখা ছিল। শুকিয়ে যাবার কারণে কেবল কাঁটাগুলোই দেখা যাচ্ছিল। 

আমি কবিতার ভাবনায় শব্দের খোঁজে আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগর একাকার করে ফেলছিলাম। ইতোমধ্যে হঠাৎ মনে হলো- আমার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘাড় ঘুরাতেই দেখি, আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক। মাননীয় মজিবর রহমান স্যার। আটলান্টিক থেকে কতো দ্রুত বাবলা তলায় এসেছি তা বলতে পারবো না। কিন্তু স্যারের নাগালের বাইরে যাওয়ার একমাত্র পথ হলো ঐ বাবলা কাঁটা। স্যারকে দেখে দশ হাত পরিমাণ ভয় পেয়ে যখন বাবলা কাঁটার দিকে তাকাই তখন বারো হাতের সমান ভয় পাই। আবার, বাবলা কাঁটা দেখে বারো হাত পরিমাণ ভয় পেয়ে হেড স্যারের দিকে তাকাই, তখন চৌদ্দ হাতের সমান ভয় পাই। ভুলে গেছি- হয়তোবা কেঁদেই দিয়েছিলাম। স্যার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। বাবলা কাঁটা ওনারও নজর এড়ায় নি। বললেন- ওদিকে কাঁটা আছে! সাবধান! আস্তে আস্তে উপরে উঠে আয়। 

বাবলা গাছের ছায়ার জন্য রাস্তা থেকে সামান্য নিচের দিকে বসেছিলাম। কি আর করা! হাজার হলেও প্রধান শিক্ষক। ওনাকে ফাঁকী দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমি বাধ্য ছেলের মতো উঠে এলাম। স্যার আমাকে ওনার সাইকেলের সামনে বসিয়ে স্কুলের পথ ধরলেন।

শেষকথা: স্যারের সাথে আরো অনেক স্মৃতি আছে আমার। মেনে চলারও চেষ্টা করি। স্যার আপনি যেখানেই থাকেন- আপনাকে সালাম। 

-

সাগর আল হেলাল

১৩.০৩.২০২২

-:-

যারা এই স্মৃতিচারণ পড়লেন- তাদের জন্য শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। বাবলা কাঁটা থেকে সাবধান ! চিনে থাকলে ভালো, না চিনলে চিনে নিন। বাবলা ফুলের কানের দুলের কথাটি ভুলবেন না যেন !




Post a Comment

Previous Post Next Post