দুঃখের শেঁকড়ে বিষ্ময়কর সুখ

 


সাগর আল হেলাল

লতা মাসির ঘরে ফিরতে বেশ একটু দেরিই হবে। অনেক পুরাতন মানুষ সে এ বাড়ির। সকলেরই খোঁজ খবর রাখে সে। আরতি দেবী এ জন্য তাকে অতিরিক্ত অর্থ ও ভালোবাসা দুই-ই দিয়ে থাকেন। মাসির কাছ থেকেই শুনেছে চারুলতা। এ জন্য লতা মাসির জন্য দেরি না করে শুয়ে পড়েছে সে। মনটা তার খুব খারাপ আজ। ভীষনভাবে মায়ের কথা মনে পড়ছে তার। ইচ্ছে করছে মায়ের বুকে মাথা রেখে হাউ-মাউ করে কাঁদতে। মা কালী কেন তার উপর এতো বিমুখ হলেন বুঝতে পারে না চারুলতা। তাদেরতো সবই ছিলো। তাহলে আজ তার এই অবস্থা কেন ? কেন ? চোখের কোল বেয়ে কাজল ভিজেয়ে নেমে আসে গরম জলের ধারা।

চারুলতাদের সুখের সংসার ছিলো। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। গঞ্জে বাবার বিরাট হোটেলের কারবার ছিলো। দুটো গুদাম ঘর ছিলো। এক বছরের আয় পাঁচ বছর খেতে পারতো। সে বছর দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো চারুলতা। সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতো। সুন্দরী হওয়াতে কতো ছেলে তার পিছু নিয়েছে। কাউকে পাত্তা দিতো না সে। নিজে চঞ্চলা হরিণী হলেও শান্ত, ধীর-স্থির ছেলে পছন্দ করতো সে। কিন্তু ঐ বয়সে কি স্থির স্বভাবের হয় ! বাবা ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু মা চেয়েছিলো লেখা পড়া করাতে। এ জন্য বাবা-মায়ের অনেক ঝগড়াও দেখেছে সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা-ই জয়ী হয়। চারুলতার লেখাপড়া চলতে থাকে।

একদিনের কথা মনে পড়ে চারুলতার। স্কুল থেকে এসে সাইকেলখানা ঘরের সাথে ঠেঁস দিয়ে রেখে, বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে চারুলতা বলছিলো-
- মা, খাইতে দেও। খুব ক্ষিদা লাগছে।
- বাড়িতে ঢুকলেই তোমার ক্ষিদা লাগে !
- তোমার হাতের রান্নার স্বাদ মনে হতেই ক্ষিদা দৌড়াইয়া আসে। সাইকেলের গতির চাইতে দ্রুত। না হলে অহন তুমি রান্না করতাছো ক্যান ? আমার ক্ষিদায় তোমারে খবর কইছে, তাই না মা ?
- শোন মেয়ের কথা শোন। আমি যখন থাকবো না, তখন কি হইবো ? পরের বাড়ি গেলি তখন বুঝবি !
- তুমি কি আমারে কাঁন্দাইবা ?

মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলেছিলো চারুলতা। চারুলতার আগেই তার মা কেঁদে ফেলেছিলো সেদিন। তার বুকের গহীন থেকে অস্ফুট কান্না জড়িত শব্দে বের হয়ে আসে- মা !

চারুলতার বাবা হরিপদের কেন জানি মতিভ্রম হয়। জুয়ায় তাকে পেয়ে বসে। এক পর্যায়ে বৎসরান্তে হোটেল ছাড়া সব কিছুই খুইয়ে বসে সে। এদিকে ঐ বৎসর যমুনা-ও বিরূপ হয়ে যায়। গঞ্জের বাজারে আছড়ে পড়ে তার হিংসার থাবা। একদিকে গুদাম হারানোর কষ্ট অন্যদিকে যমুনার বৈরী আচরণ। চারুলতার বাবা ভেঙ্গে পড়েন। বাড়ি এসে কারো সাথে ঠিক মতো কথা বার্তা পর্যন্ত বলতো না। খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো করতো না। স্বাস্থ্যও ভেঙ্গে পড়েছিলো। একদিন সকালে চারুলতার বাবা গঞ্জে গিয়ে দ্যাখে তার হোটেলসহ আরো অনেকের দোকান পাট যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে চারুকলার বাবা গঞ্জেই জীবন দিয়ে বসেন। মায়ের সিঁথির সিঁদুর মুছার দৃশ্য মনে হতেই গলগল করে অশ্রু নেমে আসে চারুলতার চোখে।

দরজায় খুট করে শব্দ হয়। চারুলতা বুঝতে পারে লতা মাসি এসেছে। বুকের ভেতর জ্বলন্ত আগুন, নয়ন ভরা অশ্রু নিয়ে সে ঘুমের ভান করে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে থাকে। লতা মাসি জানে, চারুলতা এখনো ঘুমোয় নি। মেয়েটিকে আজাে বেশি কড়া কথা বলে ফেলেছে সে। এটা হয়তো উচিৎ হয়নি। কিন্তু, আরতি দেবী ও সুবলের কথা ভেবেই তাকে এমন রূঢ় আচরণ করতে বাধ্য করেছে। চারুলতার জন্য মাসির বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। বিছানার কাছে এসে আদর মাখানো গলায় ডাকে-
- ও চারু, ঘুমাইছস্ ?
সাড়া না পেয়ে, আবার ডাকে-
- ও চারু, শরীর খারাপ করছে ?
তবুও চারুলতা কোন সাড়া দেয় না। লতা মাসি দুর্গা দুর্গা বলে চারুলতার পাশে শুয়ে পড়ে। পরম স্নেহে চারুলতাকে বুকে আগলাতে যায়। চারুলতাও যেন এমনই এক তৃষ্ণা বুকে নিয়ে ছটফট করছিলো। মোমের মতো গলে সে লতা মাসির বুকের সাথে মিশে যেতে চাইলো। তারপর মাসির বুকের মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠলো। মাসী তার বুকের আরো গভীরে চারুলতাকে আগলে নিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, ওপাশের দোতলায় আজও আলো জ্বলছে।
-
৬.৪.২২


চলবে-

Post a Comment

أحدث أقدم